সমর্পিত সন্ধ্যার গান: অন্তরাত্মার সংবেদনশীল পথ

মেহেদি আশরাফ

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২১

সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে কবি সানোয়ার রাসেলের পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ `সমর্পিত সন্ধ্যার গান`। বইটিতে সংকলিত হয়েছে একান্নটি কবিতা। কাব্যগ্রন্থের সামগ্রিক বিবেচনায় বলা যায়, সময়ের সংলাপ ও আত্মশুদ্ধির পথ সংবেদনশীলতার সাথে লিপিবদ্ধ হয়েছে এই গ্রন্থে। কবিতায় সৃষ্ট চরণের মতো সমাজের মানুষেরাও এই পথেই হয়তো নিজেদের সময়কে সমর্পন করে অথবা করতে চায় আনমনে। মানুষের নির্লিপ্ততা, বোধ, চাওয়া, আশা-নিরাশা ইত্যাদির সুসংবদ্ধ বিন্যাস এ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো।

বইটির প্রথম কবিতার নাম `খাদিজা`। এ কবিতায় কবি এক বোধের কথা বলেছেন, যা শুরুতেই অশান্ত করে তোলে মানবিক হৃদয়ের কপাট। কবির ভাষায়, `মানুষ তার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে মানুষের উপর —মতবাদ`। অতঃপর ধৈর্যধারণ ও প্রশান্তি প্রাপ্তির আবহাওয়ায় নিজেকে সমর্পনের দিকে নিয়ে গেছেন কবিতায়। বলে উঠেছেন, `সেই পরম সান্ত্বনার চাদর কোথায় পাব?` অশুদ্ধ ও অশান্ত সন্ধ্যার মাঝেও নিজেকে পবিত্রতার দিকে টানতে থাকার যে তাড়না, অধিকাংশ কবিতায় তা উদ্ধৃত হয়েছে।

`কবি` কবিতায় কবির আগমনের জন্য নানা আয়োজনের ভিড়ে মানুষকে কবি সম্পর্কে ভুল ধারণা পোষণ করতে দেখা যায়। পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতার সাথে মিলিয়ে কবি সম্পর্কে যে মতামত গ্রহণ করেছিলেন, তা ভুল প্রমাণ করলেন এবারের কবি। এই মিথ্যা বাহাস থেকে উত্তরণের পথ খুঁজছেন কবি এইরূপ বিভিন্ন কবিতায়।

`রুমাল` কবিতায় কবি এক আশ্চর্য ও চির সত্য রুমালের আশাবাদ ব্যক্ত করেন। মানুষ যেন একই পথে হেঁটে মানুষের ভালবাসার সন্ধান করছেন। ভালোবাসায় সন্তুষ্ট হচ্ছে এবং গা ভাসিয়ে দিচ্ছে সময়ের স্রোতে। তাদের জন্য কবি এক আশ্চর্য রুমাল সংরক্ষিত করে রেখেছেন, যে রুমাল তিনি নির্বিশেষে মানুষকে ব্যবহার করতে বলছেন। সে রুমাল মেকি সিক্ততাকে শুষে নিয়ে সত্য পথের সন্ধান দেবে তাদের।

`না-দেখা` কবিতায় কবি দৃষ্টিগ্রাহ্য এ জগৎ সংসারের আড়ালে কতকিছু অদেখা হয়ে থাকে সেই সব কিছুকে দেখার প্রবল আকুতি প্রকাশ করেছেন এভাবে— `এমনতর ছোট বড় অনেক না-দেখা  নিয়ে হঠাৎ মরে গেলে এইসব আফসোস মনে থাকে যদি।` পরপর কয়েকটি কবিতাতে একটা ঝাঁঝালো বোধ আশার দিকে মানবিক তাড়নাকে টেনে নিয়ে যায় এইসব কাব্যিক উক্তিতে।

অতীত যেভাবে মানুষকে তাড়িয়ে বেড়ায় সেইসব অব্যক্ত অনুভূতির প্রকাশ `মানুষ একটা আটকে যাওয়া ঘুড়ি` কবিতা। কবিতার শুরু হয়, `যা কিছু নষ্ট হলো সে সব ভেবে/কষ্ট কেন পাও` এমন এক দারুণ উদ্ধৃতির মাধ্যমে, আর পরিসমাপ্তি ঘটে— `আটকে গেছে স্মৃতির জলে/একটা তুমি ডুব!` মানবমন স্মৃতিকাতরতার যে দিকটি ছেঁকে নিয়ে জল এবং তার ওপরে ভাসা শ্যাওলার সমন্বয় করে তারই প্রকাশ এ কবিতা।

অপূর্ব ব্যঞ্জনায় প্রতিধ্বনিত হয়েছে `সেই ছেলেটি` কবিতায় একটি ছেলের দুরন্ত শৈশব থেকে পরিণত বয়সে উঠে আসার গল্প, তার প্রেম পরিণতি ও জীবন স্পর্শ করা কতিপয় বিষয়। কবিতায় ধ্বনিত হয়েছে— `সেই ছেলেটাও পড়ল প্রেমে সেদিন থেকেই উচ্ছলতা গেল থেমে সেই ছেলেটির খবর নিও সময় পেলে।` আবার এই যাবতীয় দুরন্তপনা ও অনিয়মগুলো যেন থমকে যায় আকস্মিক প্রেমের আবির্ভাবে।

মহামারির সময় যে উত্তাল ভাবনা ও থমকে যাওয়া সময়ের আর্তনাদ প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল, তারই অনুভূতি লেখক প্রকাশ করেছেন `কোয়ারেন্টিন` কবিতায় এভাবে— `সবকিছু শেষ হয় শেষ হয়ে যায় কেয়ামত শেষে লোকে আবার দাঁড়ায় এইসব হাহাকার শেষ হলে পরে আবার যুগল হব ঘরে ও বাহিরে।`

কাব্যগ্রন্থের নাম কবিতা `সমর্পিত সন্ধ্যার গান` কবিতায় একঝাঁক জীবনমুখী পোকার কথা বলে শুরু করা হয় কবিতা। ঝিঁঝি পোকার ডাকের শব্দের সাথে যেন প্রভুর মহিমা ও হুকুমের ধ্বনি অনুরণিত হয় অন্তরে। `রশি` এবং `একটি স্পর্শকাতরতার গল্প` কবিতায় যথাক্রমে কবির ভ্রান্ত বন্ধন থেকে মুক্ত জীবনযাপনকেই সমর্থন ও কবিতার গুরুত্ব প্রাপ্তির হেতু ও নিজেস্ব ভাবাবেগ প্রকাশিত হয়েছে।

`আল মাহমুদ` কবিতায় কবির প্রয়াণ ও তার জৈবনিক বিভিন্ন অনুষঙ্গের মধ্য দিয়ে স্মরণ করা হয়েছে। কবিতায় বলা হয়েছে—
আর কি গো হবে খোঁজা নদীদের জলে
আর কি গো হবে লেখা উপমহাদেশ
নিথর হয়েছে কবি আল মাহমুদ
কবিতায় তাঁর কথা বলে যাবে দেশ

সর্বোপরি আল মাহিমুদের প্রতি প্রবল ভালোবাসা, শ্রদ্ধাবোধ ও কবির গুরুত্বই প্রকাশ পেয়েছে কবিতায়। নিজের অনুপস্থিতি কল্পনা করে প্রিয়জনকে কবি বলে যাচ্ছেন তার হৃদয়াবেগ `না থাকাথাকি` কবিতায়। কবির ভাষায়—
ধরো আমি আর নাই
এই পৃথিবীর কোনোখানে—
তখন তোমার জন্য আমার খুব দুঃখ হবে, জানো?

নিজের নিত্য বিচরণের স্থানগুলোও অনাড়ম্বরেই উল্লেখ করেন কবিতার কলাকৌশলে। পাঠকহৃদয়ে অকল্পনীয় আবেগ যেখানে অকস্মাৎ সৃষ্টি হয়। `সমর্পিত সন্ধ্যার গান` কাব্যের অধিকাংশ কবিতাই অন্তরাত্মার প্রেমকাব্য হয়ে পাঠকের মনে সংবেদনশীল পথ তৈরি করে। যে পথে মানুষ আঁধার থেকে আলোর দিকে ছুটতে শেখার আহ্বান শোনে। সেই ধ্বনি সেই কথাই যেন পবিত্র সুর ও শেষে পরিপূর্ণ গান হয়ে সামনে আসে। উল্লিখিত কবিতাগুলো ছাড়াও অধিক গুরুত্বপূর্ণ, বাকবিন্যাস ও ভাবাবেগে অগ্রগামী অনেক কবিতা রয়েছে এই গ্রন্থে।

মানবমনের স্থিতিশীল ও অস্থিতিশীল রূপরেখার যে সমন্বয় ঘটেছে এ কাব্যে, তা প্রশংসার দাবিদার। বুকের গভীরে ধ্বনিত অভিব্যক্তিই গান হয়ে সন্ধ্যার দিকে এগিয়ে গেছে। এই গানের সাথে সাথে সন্ধ্যাও সমর্পিত হয়েছে বলেই আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়।

একুশে বইমেলা ২০১৮