সানোয়ার রাসেলের `অন্ধ মুসাফির`: যৎকিঞ্চিৎ পাঠ-প্রতিক্রয়া

কাজী নাসির মামুন

প্রকাশিত : জানুয়ারি ০৪, ২০২১

প্রিয় সানোয়ার রাসেল,
শুভেচ্ছা জানবেন। আপনার `অন্ধ মুসাফির` কাব্যগ্রন্থটি পড়া হলো। তাৎক্ষণিক পাঠ-প্রতিক্রিয়া হিসেবে এই নাতিদীর্ঘ কথাগুলো চিঠির আঙ্গিকে লিখতে ইচ্ছে হলো। সমালোচকের মাস্টারিতে কবির কিছুই আসে যায় না। তবু সমালোচনা সাহিত্যের একটি প্রচল ধারা হিসেবে বিরাজমান। আমি এর বাইরে থেকে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করার স্বার্থে লিখছি মাত্র। আপনি একে উপেক্ষাও করতে পারেন। আর সমালোচকের ক্ষেত্রে আমরা সবাই জানি যে, `চোখে তার অক্ষম পিঁচুটি`। কাজেই সেই অক্ষমতাকে গ্রাহ্য করার কিছু নেই। আবার এই প্রতিক্রিয়া আপনার উপকারেও আসতে পারে। তাই লিখছি।

আপনি মূলত ঘোর ভাঙার কবিতা লেখেন। আপনার লক্ষ্য অবচেতনা নয়, সচেতনতা। সমাজ ও রাষ্ট্রের বহু অসঙ্গতি, উপদ্রুত ক্ষতের চিহ্ন, আন্তর্জাতিক অনাচার এবং পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান ন্যায়হীনতার বিপক্ষে আপনি শাণিত ও অধিকতর স্যাটায়ারিক। এই স্যাটায়ারিক এপ্রোচ আপনার কবিতাকে নিজস্ব নির্মিতির দিকে নিয়েছে। তাই আপনার কবিতার আঙ্গিক ও ভাববস্তু ওতোপ্রোতো। আপনার কবিতা স্যাটায়ারিক কিন্তু অধিক পোয়েটিক হওয়ার জন্য আরও পরিচর্যা দেওয়া প্রয়োজন মনে করি। `অন্ধ মুসাফির` গ্রন্থটি স্বরবৃত্ত চর্চার আকর গ্রন্থ। তবে সেখানেও মাত্রাবৃত্ত এসে জেঁকে বসেছে কোথাও কোথাও। মাত্রা সংখ্যায় কম-বেশি হওয়ায় দু`এক জায়গায় ছান্দিক বিপর্যয় পরিলক্ষিত হয়। সাক্ষাতে এবিষয়ে বিস্তর বলা যাবে। আপনার মধ্যে কবির চোখ আছে। প্রয়োজন কবির দৃষ্টিপাত। সেটাও কোথাও কোথাও নান্দনিক বিভায় প্রোজ্জ্বল। উন্নয়ন যে অবকাঠামোগত আধুনিকতার বাহ্যিক প্রকরণ, ভেতরে ভেতরে একটা অনাকাঙ্ক্ষিত প্রাকৃতিক ধ্বংসলীলা, সেটি আপনার কবিতায় স্পষ্ট। এই স্পষ্টতা আপনার দৃষ্টিপাতের গুণাবলিকে গ্রাহ্য করতে শেখায়। তবে সেই দৃষ্টিপাত অতিশয় বিদ্রুপাত্মক বলে মস্তিষ্কপ্রসূত একটা বুদ্ধিবৃত্তিক দ্যোতনা আনে। একটা মরমী সংযোজনা আপনার কবিতাকে আরও বেশি হৃদয়গ্রাহী করতে পারতো।

মিস্টিক অর্থে মরমী বলছি না। `মর্ম থেকে আগত` অর্থে `মরমী`। আপনার কবিতায় উইট আছে। এতে আপনার কবিতা ভিন্ন মাত্রা পায়। তবে হৃদয়জাত কবিতাই অধিকতর সংবেদনা নিয়ে পাঠককে তাড়িত করে। যতটা মস্তিষ্ক প্রয়োজন তা আঙ্গিকের প্রয়োজনে নির্মিতির কাঠামোয় সীমিত রাখা প্রয়োজন। কবিতাকে কৌতুকময় করবার যে-প্রবণতা তা আপনার দোষ ও গুণ। দোষ, কেননা কৌতুক কবিতাকে মজাদার করে তোলে। শৈল্পিক আনন্দের জমাট গাম্ভীর্য কখনো কখনো খেলো হয়ে যায়। গুণ, কেননা সমাজ বৈরী হলে তার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হয় কোথায় তার জন্য অপেক্ষা করছে সুতীক্ষ্ণ বিদ্রুপ। কবিতা সেক্ষেত্রে হতে পারে বৈরী সমাজের জন্য ব্যাঙ্গাত্মক অস্ত্র। জ্বালাধরা চুতরার পাতা। এই প্যারাডক্সের মধ্যে আপনার নিজের পথ নিজের কাছেই আছে। ধর্মীয় শব্দের শৈল্পিক ব্যবহার আপনার কবিতাকে ঋদ্ধ করেছে। সেক্ষেত্রে অপ্রচল আরবি শব্দের অর্থবোধকতার ক্ষেত্রে পাঠক কোথাও কোথাও ঝামেলায়ও পড়তে পারে। কিন্তু একথা নিশ্চিত যে, ধর্মীয় অনুষঙ্গের সাবলীল ব্যবহার আপনার কিছু কবিতাকে পৌরাণিক ব্যঞ্জনা দিয়েছে। ইঙ্গিৎময় করে তুলেছে অন্তর্নিহিত ভাবের জগৎ। এভাবেই কবিতা গভীরতর হয়ে ওঠে। কিন্তু আপনার কবিতা ধর্মাক্রান্ত না হোক, এই আন্তরিক বাসনা পোষন করি আমি।

আপনার `সন্ধ্যা নামার আগে` কবিতাটি নান্দনিক বিভায় অনেক বেশি পোয়েটিক হয়েছে। `লিউ` কবিতায় ইঙ্গিতময় হয়েছে গুম হওয়া মানুষের জন্য সমবেদনায় আক্রান্ত হৃদয়ের আর্তি। আর দার্শনিক ফ্যালাসির বিরুদ্ধে সূক্ষ্ম স্যাটায়ারে বিদ্ধ করে `কেন্দ্রীয় বিষয়সমূহ` কবিতাটি। তিনটি কবিতাই পাঠকের উদ্দেশ্যে তুলে দিলাম। আপনার কবিতায় অন্ধ মুসাফির মূলত চক্ষুষ্মান। ভবিষ্যতে আপনিও আরও দৃষ্টিমুখর হবেন, সেই আশাবাদ রইলো।

সন্ধ্যা নামার আগে

এই যে শিশুর পদরেখা সাক্ষ্য দিচ্ছে স্তব্ধতার আর
পাখির পালক হয়ে মাঠজুড়ে পড়ে আছে মেহগনিবীজ
মেঘশিরিষের পাতা মৌন শোকে পোহাচ্ছে বিগত হাওয়ার
বিষকাটালির ঝোপে আড়মোড়া ভাঙছে জোনাকি
গৃহগামী হাঁসেদের ঝাপটানো ডানার দিকে চেয়ে আমি ডাকি
মাবুদ
এমন
সন্ধ্যার সূচনায়
আরেকটিবার
আমাকে জন্ম দিও
মৌনতার প্রয়োজনে
এ জন্মের সমস্ত শব্দপুঁজি ব্যয় করে চলে যাব
কথা দিলাম।

লিউ

যে শহরে শিশুরা হারায় বাঁশি শুনে
তার নাম ভুলে গেছি
ভুলে গেছি ধোঁয়াওঠা চায়ের পেয়ালা
ভুলে যাওয়া চুমুকেরা পথ ভুলে চলে গেছে অন্য কোথাও
ভুল পথে হেঁটে গেছে সকল সংগ্রাম
প্রেমিকারা ভুল করে চলে গেছে ভুল ঘরে
ভুল বিছানায়
ভুল করে ভুল ট্রেনে চড়ে ভুলোমনা কিছু কবি
চলে গেছে সেই আমনুরা
ভুল মাঠে ভুল রেসে হেরে গেছে বাজিধরা ঘোড়া
যে শহরে শিশুরা হারায় বাঁশি শুনে
তার নাম ভুলে গেছি।
সে শহর ভুল করে এই দেশে পেয়েছে ঠিকানা
ছেলেধরা ভুল করে ধরে নিয়ে যায় আজ পিতা
মানুষেরা কই যায়
কোথায় হারায় এই দেশে
কেউ তা জানে না
কেউ তা জানে না

কেন্দ্রীয় বিষয়সমূহ

একটা ধইঞ্চার চারাকে দেখিয়ে তিনি বললেন, এই হলো পৃথিবীর
কেন্দ্র, বুঝলেন সানোয়ার রাসেল?

যদিও ওখানে বোঝার কিছু ছিল না, তবু মাথা দোলালাম।
‘আর এই আমি হচ্ছি পৃথিবী।` বলেই তিনি চক্রাকারে ঘুরতে লাগলেন
ধইঞ্চাকে কেন্দ্র করে!

তিনি ঘুরতে ঘুরতে আরও কী সব বলতে লাগলেন,
কিন্তু সেসব আর কানে তুললাম না।
পৃথিবীর কথা কে কবে শুনেছে বলুন?

পৃথিবীকে বনবন করে ঘূর্ণায়মান রেখে অন্যদিকে তাকালাম।
সেখানে গোবরকে কেন্দ্র করে প্রচুর ফুল ফুটেছে।
মনে মনে ভাবলাম, পরিধিতে থাকাটাও মন্দ নয়।
জগতে আজকাল ধইঞ্চা ও গোবরবৃন্দই কেন্দ্রীয়।
এইসব গূঢ় কথা আবার যত্রতত্র বলে বসবেন না যেন!
কেননা,
ঈশ্বর ঘিলুর বণ্টনে সাম্যবাদী ছিলেন না কখনো।

অন্ধ মুসাফির’ বইটি প্রকাশ করেছে প্রিন্ট পোয়েট্রি। সানোয়ার রাসেলের প্রকাশিত আরও কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ হলো- তবুও বসন্ত, নিমগ্ন পঙতিমালা, ভাঁটফুল ও ভালোবাসার কাব্য।

একুশে বইমেলা ২০১৮