সুলতান সুলায়মান ধারাবাহিকের কাল্পনিক চরিত্ররা

পর্ব ২

মারিয়া সালাম

প্রকাশিত : মার্চ ০৬, ২০২৩

সুলতান সুলায়মান ধারাবাহিকে প্রধান কিছু চরিত্র ছাড়া বেশিরভাগই কাল্পনিক। ইতিহাস ঘাটলে সুলায়মানের হারেম সম্পর্কে খুব কম জানা যায়। তাই সেসময়কার হারেমের প্রকৃত অবস্থা বুঝাতে কিছু কাল্পনিক চরিত্রের অবতারণার প্রয়োজন অবশ্যই ছিল। কিন্তু, ধারাবাহিকটিতে অনেক কাল্পনিক ব্যক্তিকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখানো হয় যা প্রকৃত ইতিহাসের বিপরীত। সেরকম চরিত্রগুলো নিয়ে তিন কিস্তির মধ্যে আজ থাকছে দ্বিতীয় কিস্তি।

 

আরেকটি কাল্পনিক চরিত্র সাদেকা হাতুন। ধারাবাহিকটিতে দেখা যায়, সাদেকা হাতুন একজন হাঙ্গেরিয়ান নারী এবং তার বিয়ের দিনেই সুলতান তার স্বামীকে হত্যা করেন। এরপর সাদেকা ইস্তাম্বুলে চলে আসে স্বামী হত্যার প্রতিশোধ নিতে। এখানেও ভাগ্যক্রমে তার দেখা হয় ওই নাসু ইফেন্দির সাথে এবং নাসুই তাকে হারেমে নিয়ে আসেন। হারেমে এসেই সাদেকা ওয়ালিদা সুলতানার সেবায় নিয়োজিত হন এবং পরবর্তীতে হাতিজা সুলতানার খাস সহযোগী হিসেবে নিয়োগ পান। আবার যথারীতি সে সুলতানের সাথে অন্তরঙ্গ হবার সুযোগ পান। একপর্যায়ে সুলতানকে হত্যা করতে ব্যর্থ হয়ে ধরা পড়ে এবং তাকে বসফরাসে নিক্ষেপ করা হয়।

 

এই গল্পের কোনো ভিত্তি নাই। বাস্তবে এরকম কেউ ছিল না বা এরকম ঘটনা ঘটা সম্ভব নয়। একজন বিবাহিত বা প্রাপ্তবয়স্ক নারী কখনোই হারেমে সুলতানের খেদমতে বা মনোরঞ্জনে নিয়োজিত হতে পারত না। কেবলমাত্র, কুমারী ও অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুকন্যাদেরই হারেমে নেওয়া হতো। আর ওয়ালিদা সুলতানার খেদমতে নিয়োজিত হবার আগে তাদের দীর্ঘদিন বিভিন্ন শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হতো।

 

আরেকজন কাল্পনিক চরিত্র হচ্ছেন আইবেগ হাতুন। বলা হয়, আইবেগ ওয়ালিদা সুলতানার ভাতিজি এবং ক্রিমিয়ান খান সাহেবের মেয়ে, যে ক্রিমিয়া থেকে ইস্তাম্বুলে তার ফুফুর সাথে দেখা করতে আসে। একপর্যায়ে, ওয়ালিদা সুলতানা তাকে শাহজাদা মুস্তফার জন্য পছন্দ করেন। কিন্তু আইবেগ বালি বে`র সাথে প্রেমে জড়িয়ে পড়েন। যার জন্য বালি বেকে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়। পরে আইবেগকে আবার ক্রিমিয়াতে ফেরত পাঠানো হয়।

 

এই গল্পে পদে পদে কল্পনার আশ্রয় নেওয়া হয়। প্রথমত, ওয়ালিদা সুলতানা আয়েশার ক্রিমিয়ান খানদের সাথে কোনো রক্ত সম্পর্ক ছিল না। তাই একজন ক্রিমিয়ান খানের মেয়ে আয়েশার ভাতিজি হতে পারেন না। উপরন্তু, সাহিব খানের অনেক কন্যা ছিল কিন্তু তাদের মধ্যে কারো নামই আইবেগ ছিল না আবার তাদের কেউ কোনো দিন ইস্তাম্বুলে আসেননি।

 

আর যদিও বালি বে একজন শক্তিশালী ঐতিহাসিক চরিত্র, ধারাবাহিকে তাকে যেভাবে দেখানো হয়েছে, তিনি সেরকম ছিলেন না। সত্যিকার বালি বে কখনোই প্রেমিক পুরুষ ছিলেন না বরং তিনি খুব নিষ্ঠুর সেনাপতি ছিলেন। যার জীবনে প্রেমকাহিনি বলে কিছু ছিল না। হুররমের মেয়ে মিহির`মার সাথেও তার আন্তরিকতা ছিল না।

 

অপরদিকে, মুস্তফার সাথে কারো বিয়ের কথা চিন্তা করাটাও বাস্তবসম্মত না। সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মাদের সময় থেকে আইন করে শাহজাদাদের বিবাহ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তাই, ধারাবাহিকটিতে শাহজাদাদের স্ত্রী হিসেবে যাদের দেখানো হয়েছে, তারা কেউই রাজ পরিবারের বধু ছিলেন না। সেসময়, শাহজাদারা অবিবাহিতই থাকতেন।

 

সুলতানের জীবনে আরেকজন প্রভাবশালী নারী হিসেবে দেখানো হয় ফিরোজা হাতুনকে। সে একজন পারস্য গুপ্তচর যে হারেমে ঢুকে পড়ে একজন দাসী হিসেবে। পরে, শাহজাদা জাহাঙ্গীরের সেবা করে সে হুররমের আস্থাভাজন হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে সে সুলতান সুলায়মানের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে এবং হুররামের সমমর্যাদার দাবিদার হয়ে ওঠে। কিন্তু হুররম তার আসল পরিচয় ফাঁস করে দিলে তাকে প্রাসাদ থেকে বহিষ্কার করা হয়।

 

বাস্তবে, হুররমকে বিয়ে করার পর থেকে সুলতান অন্যকোন নারীর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন এরকম কোনো দলিল নেই। হুররম ছাড়া তার আর কোনো নারীসঙ্গী ছিল না। আর হারেমে নারী গুপ্তচর থাকাটাও খুব স্বাভাবিক ঘটনা নয়। অবশ্যই সব প্রাসাদেই কিছু গুপ্তচর থাকত। কিন্তু এভাবে প্রাপ্তবয়স্ক নারীরা যে কোনো সময় হারেমে ঢুকতে পারত না। হারেমের নারীদের নিয়ে আসা হতো শিশুকালে, তাই গুপ্তচর হবার মতো যোগাযোগ তাদের ছিল না। বরং এক্ষেত্রে আঘাদের গুপ্তচর হওয়ার সুযোগ অনেক বেশি ছিল।

 

হারেমে অবশ্যই কিছু বয়েস্ক নারী বা বিবাহিত নারীদের চাকরি হতো। সেটা রান্নাঘরের বা অন্যান্য কাজের জন্য। তাদের সাজপোশাক সেরকম জাঁকজমকপূর্ণও হতো না। যাতে করে সুলতান বা শাহজাদারা আকৃষ্ট হতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, মনোরঞ্জনের নারী হবার মতো তাদের যথেষ্ট শিক্ষাও ছিল না। চলবে