স্বকৃত নোমানের গদ্য ‘শত জ্যোৎস্নার মাধুরী’

পর্ব ৩

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৮, ২০২৪

প্রতি বছর কলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তকমেলা ও বাংলাদেশের একুশে বইমেলার আগে একটা বিতর্ক প্রবল হয়ে ওঠে। কলকাতার কিছু লেখক-পাঠকের অভিযোগ, কলকাতা পুস্তকমেলায় বাংলাদেশের প্রকাশকেরা অংশ নিতে পারেন, বাংলাদেশের একুশে বইমেলায় কেন কলকাতার প্রকাশকরা অংশ নিতে পারেন না?

কারো কারো ধারণা, বাংলাদেশ কৌশলে একুশে বইমেলায় কলকাতার প্রকাশকদের অংশগ্রহণ করতে দেয় না, ইচ্ছে করেই কলকাতার লেখকদের বই প্রকাশ করে না। কারণ, কলকাতার প্রকাশকরা একুশে বইমেলায় অংশ নিলে, একুশে বইমেলায় কলকাতার লেখকদের বই প্রকাশ ও বিক্রি হলে বাংলাদেশের লেখকরা হালে পানি পাবে না, তাদের বই কেউ কিনবে না।

কলকাতায় আমার প্রকাশক অভিযান পাবলিশার্স। আমার উপন্যাসগুলো পশ্চিমবঙ্গের পাঠকদের জন্য অভিযান থেকে প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশে এগুলো বিক্রি নিষিদ্ধ। বইয়ের ইনার পেজে এই নিষিদ্ধের কথা স্পষ্টভাবে লেখা থাকে। কলকাতা পুস্তকমেলায় যথারীতি এবারও অভিযান অংশ নিচ্ছে। সেই উপলক্ষে আজ সকালে একটা বিজ্ঞাপন শেয়ার করেছি ফেসবুকে। ক্যাপশনে লিখেছি, ‘কলকাতার অভিযান পাবলিশার্স প্রকাশিত আমার উপন্যাসগুলো পাওয়া যাবে কলকাতা পুস্তকমেলায়।’

ফেসবুক ফ্রেন্ড বিপ্লব কর্মকার সেই পোস্টে কমেন্ট করলেন, ‘আপনার বই কলকাতা বইমেলায় বিক্রি হচ্ছে, অভিনন্দন। কিন্তু কলকাতার লেখকদের বই বাংলা একাডেমির বইমেলায় পাওয়া যায়?’ আমি তার কমেন্টের উত্তরে লিখলাম, ‘অভিযান আমার প্রকাশক, পরিবেশক নয়। কলকাতার কোনো লেখকের বই যদি বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়, তবে অবশ্যই একাডেমির বইমেলায় পাওয়া যাবে সন্দেহাতীতভাবে।’

জনাব বিপ্লব কর্মকার আসলে কী বলতে চেয়েছেন, কী বোঝাতে চেয়েছেন, তার মন্তব্যের উদ্দেশ্য কী, তা আমি স্পষ্টভাবেই বুঝতে পেরেছি। পরবর্তী দীর্ঘ মন্তব্যের একাংশে তিনি লিখলেন, ‘....বাংলাদেশিদের ভয়, কলকাতার লেখকরা মার্কেট পেয়ে গেলে তাদের বই কেউ ছুঁয়েও দেখবে না।’ অর্থাৎ, একুশে বইমেলায় যদি কলকাতার লেখকরা মার্কেট পেয়ে যান, তবে আমরা যারা বাংলাদেশের লেখক, তাদের বই কেউ ছুঁয়েও দেখবে না।

জনাব বিপ্লব কর্মকার ও অন্য বন্ধুদের সদয় অবগতির জন্য, বাংলাদেশের একুশে বইমেলায় যে কলকাতার লেখকদের বই প্রকাশিত হয় না, বিক্রিয় হয় না, তার কারণ আছে। একুশে বইমেলা একটি লোকাল বইমেলা, স্থানীয় বইমেলা, আন্তর্জাতিক বইমেলা নয়। কলকাতা পুস্তকমেলা আন্তর্জাতিক মেলা, লোকাল নয়। সুতরাং কলকাতা পুস্তকমেলায় কেবল বাংলাদেশের নয়, পৃথিবীর যে কোনো দেশের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান অংশ নিতে পারবে, পৃথিবীর যে কোনো দেশের লেখকের বই প্রকাশ করা যাবে।

অপরদিকে, বাংলাদেশের একুশে বইমেলায় দেশের বাইরের— হোক তা ভারত, জাপান, চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া, কুরিয়া বা আমেরিকা— কোনো প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান অংশ নিতে পারবে না, কোনো লেখকের বই প্রকাশ করা যাবে না। কারণ এটি একটি লোকাল বইমেলা। ৫২-এর চেতনাকে ধারণ করে বাংলাদেশের লেখক-প্রকাশকদের উৎকর্ষের জন্য এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়।

তাই বলে বাংলাদেশে একটি আন্তর্জাতিক বইমেলা থাকবে না? খুবই যৌক্তিক প্রশ্ন। জি, অবশ্যই থাকা উচিত। ছিলও। ‘ঢাকা বইমেলা’ নামে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের উদ্যেগে একটি আন্তর্জাতিক বইমেলা অনুষ্ঠিত হতো। সেই মেলায় কলকাতার প্রকাশকরা অংশ নিতে পারতেন। কোনো কোনো প্রকাশক অংশ নিতেনও বটে। ঢাকা বইমেলা বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। বন্ধ থাকার কারণ, মেলাটি জমে না। পাঠক-লেখকরা তেমন অংশ নেন না। অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, ঢাকা বইমেলায় কলকাতার প্রকাশকরাও খুব একটা অংশ নিতেন না। দু’একটা প্রতিষ্ঠান নিত, বাকিরা থাকত উদাসীন। এই উদাসীনতা কেন জানা নেই।

এখানে একটা বড় প্রশ্ন আসতে পারে। সেটা হচ্ছে, একুশে বইমেলাকে আন্তর্জাতিক বইমেলায় রূপান্তর করলে সমস্যা কী? না, কোনো সমস্যা নেই। করা যেতেই পারে। কিন্তু সেটা অন্য আলাপ। সেই দাবি উঠতেই পারে। যদিও আমি মনে করি না সেই দাবি সংগত। কারণ আগেই বলেছি যে, একুশে বইমেলা একান্তই লোকাল একটি মেলা, কেবল বাংলাদেশি লেখক-প্রকাশকদের মেলা। এটাই এ মেলার ইতিহাস, এটাই ঐতিহ্য; এটাই রীতি। এখন পশ্চিমবঙ্গের কোনো বন্ধু যদি বলেন, ‘না বাপু, তোমাদের এইসব ঐতিহ্য-ফৈতিহ্য মানি না, এই মেলায় আমরাও থাকতে চাই, আমাদেরকেও রাখো, তবে সেটা অন্য আলাপ, অন্য দাবি। সেই দাবি নিয়ে আলাপ শুরু হতে পারে। সেই আইন পরিবর্তনের দাবি উঠতে পারে।

তাই বলে কি একুশে বইমেলায় কলকাতার লেখকদের বই বিক্রি হচ্ছে না? প্রকাশিত হচ্ছে না? সন্দেহাতীতভাবেই হচ্ছে। বাংলাদেশের অন্তত ত্রিশটিরও বেশি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের নাম বলতে পারব, যারা একুশে বইমেলায় কলকাতার লেখকদের কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও অনুবাদের বই প্রকাশ করে থাকে। একুশে বইমেলায় কলকাতার অনেক লেখক এসে স্টলে বসে থাকেন, পাঠকদের অটোগ্রাফ দেন। বাংলাদেশের প্রকাশকরা এটা করছে সম্পূর্ণ অবৈধ, অনৈতিক ও নিয়ম বহির্ভূতভাবে। আইন মোতাবেক এটা তারা করতে পারে না। বাংলা একাডেমি যদি ইচ্ছে করে, তবে তাদেরকে প্রতিহত করতে পারে, কলকাতার লেখকদের বইগুলো বইমেলায় বিক্রি বন্ধ করে দিতে পারে। কিন্তু বাংলা একাডেমি তা করে না। কেন করে না জানা নেই।

এবার আসা যাক বিপ্লব কর্মকার দ্বিতীয় মন্তব্যে। তিনি লিখেছেন, ‘বাংলাদেশীদের ভয়, কলকাতার লেখকরা মার্কেট পেয়ে গেলে তাদের বই কেউ ছুঁয়েও দেখবে না।’ এটা কেবল বিপ্লব কর্মকারের একার কথা নয়, এমনটা মনে করেন পশ্চিমবঙ্গের অনেক লেখক, প্রকাশক ও পাঠক। প্রিয় বন্ধু, আপনাদের সদয় অবগতির জন্য জানাই যে, বাংলাদেশে কলকাতার লেখকদের মার্কেট পাওয়ার দরকার নেই, বহু আগে তাঁরা মার্কেট পেয়েই বসে আছেন। তাঁদের বই বিক্রির জন্য কোনো বইমেলার দরকার নেই, বাংলাদেশে তাঁদের বই নিয়ে সারা বছরই মেলা চলে। পাঠক সমাবেশ, বাতিঘর, তক্ষশীলা, কথাপ্রকাশ, প্রথমাসহ অনেক বই বিক্রয় প্রতিষ্ঠান সারা বছরই কলকাতার বই বিক্রি করে থাকে। অনলাইন বই বিক্রয় প্রতিষ্ঠান রকমারি.কম তো করছেই, ঢাকার নীলক্ষেতের ফুটপাতে অহরহ বিক্রি হচ্ছে কলকাতার লেখকদের বই। বিক্রি হচ্ছে পল্টন, মিরপুরসহ দেশের নানা জায়গায়।

অপরদিকে, কলকাতার বই বাংলাদেশে যে পরিমাণ বিক্রি হয়, বাংলাদেশের বই কিন্তু কলকাতায় সেই পরিমাণ বিক্রি হয় না। কেন হয় না? বাংলাদেশের লেখকরা দুর্বল বলে? তারা লিখতে জানেন না বলে? না, মোটেই তা নয়। এর পেছনের কারণ রাজনৈতিক, কারণ সামাজিক। না হওয়ার পেছনে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিকদের সীমাবদ্ধতা, প্রকাশকদের সীমাবদ্ধতা, বই বিক্রেতাদের সীমাবদ্ধতা, সর্বোপরি পাঠকদের সীমাবদ্ধতা। পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ পাঠক মনে করেন বাংলাদেশের কেউ লিখতে পারে না, তাদের লেখাজোখা কিছু হয় না। এটা তাদের উন্নাসিকতা। এই উন্নাসিকতা কথাশিল্পী অমিয়ভূষণ মজুমদারে মধ্যে প্রবল ছিল। আরও অনেক লেখকদের মধ্যে ছিল, এমনকি এখনো অনেক লেখকের মধ্যে রয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের প্রিয় বন্ধুগণ, আশা করি আপনারা এই উন্নাসিকতা থেকে বেরিয়ে আসবেন। একটু কষ্ট করে চোখ খুলে দেখুন বাংলাদেশে কেমন কবিতা লেখা হচ্ছে, কেমন উপন্যাস লেখা হচ্ছে, কেমন গল্প আর প্রবন্ধ লেখা হচ্ছে। একটুত জানার চেষ্টা করুন এই দেশের সাহিত্য কোথায়, কতটুকু গিয়ে পৌঁছেছে। তাতে আপনাদের জানাশোনার পরিধির আরো বিস্তার ঘটবে, তাতে আপনাদের কল্যাণ হবে। পশ্চিমবঙ্গের যেসব বন্ধু এই মানসিকতা লালন করেন যে, কলকাতার লেখকরা বাংলাদেশে মার্কেট পেলে এই দেশের লেখকদের বই কেউ ছুঁয়েও দেখবে না, তাদের মূর্খতা বঙ্গোপসাগরের চেয়েও বিশাল। আশা করি আপনারা এই মূর্খতার সমুদ্র থেকে বেরিয়ে আসবেন। ধন্যবাদ ও শুভ কামনা।

১৭ জানুয়ারি ২০২৪