অলঙ্করণ: দীপাঞ্জন সরকার

অলঙ্করণ: দীপাঞ্জন সরকার

বন্ধুর কাঁধের চেয়ে আর কোনও ক্রুশ নাই

রাজীব জবরজং

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৯, ২০১৮

মৃত্যু ব্যাপারটা শৈশব থেকেই আমার কাছে প্রচণ্ড আপন।
আমি য্খন ক্লাস থ্রি, তখন থেকে আমি আত্নহত্যা শব্দটার সাথে ভয়ানকভাবে পরিচিত। সময় যত গড়ায়, আমার এই পরিচিত শব্দটার সাথে আমার সখ্য ক্রমশই বাড়তে থাকে। এই শব্দের ভেতর আমি বারবার আমাকে খুঁজতে গিয়েছি। নিজেকে খুঁজতে গিয়ে অসংখ্যবার আমি দেখেছি, আমি যতটা না প্রস্তুত আমার চিরচেনা এই শব্দটার মাঝে নিজেকে মিশিয়ে দেবার জন্য, ঠিক ততটা প্রস্তুত হতে পারে নাই আমার চারপাশের খসখসে জগৎটা। আত্মহত্যার জন্য প্রচণ্ড মসৃণ হতে হয় জগৎকে, অনেকটা শৈশবের শিশুপার্কের স্লিপারের মতো।

আমি তখন ক্লাস টু, গরুকাটা ঈদে দাদারবাড়ি গেলাম। আকাশে কত লাল, নীল, হলুদ ঘুড়ি। আমারও ইচ্ছা হলো ঘুড়ি হবার। আব্বুর কাছে আবদার করলাম, রেলস্টেশনের ঘুড়ির দোকানের সবুজ ঘুড়িটা। শৈশবে ধুলোর প্রতি আমার প্রেম না থাকলেও সেদিন সবুজ ঘুড়ির প্রেমে আমি ধুলো মাখলাম। আব্বু ঘুড়িটা কিনে দিল।
ঘুড়িটাকে আমার মাথার ওপর নাচাতে নাচাতে বাড়ি নিয়ে যেতে যেতে জানলাম, ঘুড়িটার কথা ছিল প্রজাপতি হবার। অথচ আমার শৈশবের ঘুড়িটা প্রজাপতি হবার বদলে আমার দাদার বাড়ির ঘরের বেড়ায় ঝুলে ছিল আমৃত্যু। আমি আমার শৈশবেই হয়ে উঠলাম হত্যাকারী।
আমার সবুজ ঘুড়ির লেজে চড়ে আমার জগতের সকল প্রজাপতি উড়ে গেল। আর কোনও অংকুরোদগম ঘটে না। একেকটা বন্ধ্যা ফলের গাছ, ফলের বদলে ফুলের গাছ। সবাই ভাবলো, কী সৌরভ! কী রঙের ছটা, কী রূপের নহর, আহা! অথচ ঘুড়ি হতে গিয়ে একজন হত্যাকারী ফলের স্বাদ ভুলে গিয়েছিল।
এরপর থেকে হত্যাকারীর ঘুমের ভেতর প্রজাপতি উড়ে গেলে জগতের ফুলেরা কেঁদে ওঠে। বাজারে বাজারে মাটির তরমুজ।
 
ভোর ছ`টা। ভেতর বাহির সবকিছুতেই আলো ঢুকে পড়ছে। অথচ এই বিরান ভূমিতে কোনও আলো নেই। আবার মৃত্যরঙা কোনও অন্ধকারও নেই। এর কি কোনও নাম আছে? জানি না। কেবল জানি, সময়ের পথগুলো কেবলই সরু হয়ে আসছে। সময় কেবলই শাসিয়ে বেড়াচ্ছে।
গত কিছুদিন ধরে কেবল কিছু মৃত্যুর কথা মনে পড়ছে।

তখন আমি ক্লাস টু। বাসার ছাদ থেকে পড়ে মরলো পাশের বাসার শিমু আপা। তখনও বুঝি না ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়লেই আত্মহত্যা।
কিছুদিন পর বিষ খেয়ে এক আত্নীয়, ততদিনে বুঝে গেছি আত্মহত্যা। একবার গরুকাটা ঈদে বাড়ি গেলাম। জানা গেল, রেলে কাটাপড়ে মরেছে এক মেয়ে। গ্রামের অনেকের সাথে দেখতে গেলাম। জানলাম এটাও আত্মহত্যা।
এরপর বেশ কিছুদিন রাতে ঘুমোতে পারিনি। মৃত্যু ব্যাপারটা ক্রমশই আমার কাছে তুচ্ছ মনে হতে শুরু করলো।
সময় দেখতে দেখতে অনেক পার হলো। অথচ আবারও সেই শৈশব, শৈশবে দেখা মৃত্যু আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে, কখনো কখনো সময়ের পুঁজভরা ফোড়া ফাটানোর জন্য মৃত্যু বেশ ধারালো কাঁটা।

শৈশবে বাড়ির শোকেসের ওপর রাখা চৌদ্দ ইঞ্চি নিক্কন টেলিভিশনে মুভি অব দ্য উইক ছাড়া বলার মতো আমার ভিন্ন কোনও কিছুই ছিল না। আনসার আলীর ভূতের শহরে এসে রিকশায় চড়া ছাড়া আর কোনও বিলাস আমার ছিল না।
আম্মা ছাড়া কারো চোখের দিকে তাকিয়ে কিংবা কাঁধে মাথাটা রেখে কেঁদে ফেলার মতো নিরাপদ কাঁধ অথবা চোখ চিরকালই একজোড়া।

আমি বন্ধুর কাঁধে চোখ ডুবিয়ে কেঁদেছিলাম দুয়েকবার, প্রতিবারই আমি তার কাঁধের ভেতর দিয়ে মেরির ব্যথাটা টের পেতাম। অথচ কোনও ক্রুশের সাথে যিশুকে দেখিনি কোনও দিন।
বন্ধুর কাঁধে চোখ ডুবিয়ে মেলা দিন হলো আমি কেঁদে ফেলি না। অথচ গতরাতে হঠাৎ মেরি এসেছিল কতোগুলো পেরেক হাতে। পেরেকগুলো বালিশের তলায় রেখে আমার কানে কানে বললো, নিজেকে ক্রুশে বেঁধে নিস সময় করে।
আমি বললাম, ক্রুশ কোথায় পাবো আমি? আমার তো ব্যক্তিগত কোন বৃক্ষ নেই।
মেরী বললো, বন্ধুর কাঁধের চেয়ে জগতে আর কোনও শক্তিশালী ক্রুশ নাই...