বৈষম্য

ছাড়পত্র ডেস্ক

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৫, ২০১৮

নাম শুনে মনে হতে পারে, সমাজে চলমান বৈষম্য নিয়ে বুঝি কোনও শর্টফিল্ম এটা। কিন্তু এর নির্মাতা ‘বৈষম্য’ নামটার সাথেই যে এত বৈষম্য করবেন, তা কে জানতো!


সম্প্রতি কিছুদিন ধরে ভাইরাল হয়েছে ‘বৈষম্য’ নামের শর্টফিল্মটি। কী আছে এতে? দেখতে গেলেই যা দেখা গেল, তা সত্যি লজ্জার। বিষয়: সিগারেট খাওয়া। তবে এই সিগারেট কে খাচ্ছে অর্থাৎ সে নারী না পুরুষ, তা নির্বিচারে না নিয়ে শুধুমাত্র নারীর সিগারেট খাওয়াকে ‘শেমিং’ করা ছিল এ ভিডিওর প্রধাণ বিষয়। অভিযোগ ওঠে, উনি ব্যক্তির গোপনীয়তাও ভঙ্গ করেছেন। ভাইরাল হওয়া এ ভিডিওর ভিউয়ার্স কম ছিল না। আলোচিত-সমালোচিত এই টপিক মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে সবার ওয়ালে।


সানী সানোয়ারের স্ট্যাটাসে পাওয়া যায় বৃত্তান্ত।

"মেয়েরা উন্মুক্ত জায়গায় ধূমপান করতে পারে কী পারে না, এটা নিয়েই বিতর্কের সূত্রপাত ঘটেছিল। নির্মাতা বলছেন যে, পারে না। ব্যস, এ নিয়ে শুরু হয়ে গেল এক মহাবিতর্ক। ইদানীংকালে ইউটিউবে প্রকাশিত একটি সামাজিক সচেতনতামূলক মিনি ভিডিও ড্রামা ‘বৈষম্য’ নিয়ে কথা বলছিলাম।

 

বিতর্কিত এই ভিডিওটি এখন নাকি ভাইরাল। নাকি ভাইরাল করার জন্য বিতর্কিত করে বনানো হয়েছে? অবশ্য ভিডিওটিতে আবেগের বহি:প্রকাশ দেখে মনে হয়েছে, এতে যা দেখানো হয়েছে তাতে নির্মাতার মনের কথারই প্রতিফলন ঘটেছে, কোনও ‘বিতর্ক ব্যবসা’ নয়।এদিক দিয়ে নির্মাতাকে সৎ বলেই মনে হয়েছে। তিনি একটা মানসিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েই এটা বানিয়েছেন। প্রবলেমটা অন্য জায়গায়, গোড়াতে যদি গলদ থাকে তাহলে শিল্পচর্চা সমাজের জন্য কতটা ক্ষতিকর হতে পারে তার স্পষ্ট উদাহারণ এই ‘বৈষম্য` নামের ইউটিউব ভিডিউটি।

 

প্রায় ১২ মিনিটের এই ছোট্ট নাটিকাতে লেখক মনের অজান্তে একটি ঘটনার অভিজ্ঞতার আলোকে সমগ্র নারী সমাজকে জড়িয়ে ফেলেছেন।আমার ধারণা, এরকম অসংখ্য ভিডিও অনলাইনে রয়েছে যেগুলোর কোনও শিল্পগুণ বা যৌক্তিক ভিত্তি নেই। অথচ এগুলো লাখোলাখো ভিউয়ারস দেখছে এবং সেগুলো থেকে অনেকের কাছে ভুল ম্যাসেজ যাচ্ছে কিংবা সেগুলো থেকে ভুল শিক্ষা নিচ্ছে।

 

স্নেহের অনুজ Salman Muqtadir এবং Mashroof Hossain এর দুটা ফেসবুক স্ট্যাটাস দেখে বিষয়টি আমার দৃষ্টিগোচর হলো। এরপর ভিডিওটি ইউটিউব থেকে দেখে নিলাম। দেখে বেশ অবাকই হলাম। এতটা নিম্নমানের কনসেপ্ট, বিশ্লেষণ ও স্ক্রিপ্টের ভিডিউটি এরইমধ্যে ২ লাখ ৭০ হাজার ভিউস হয়ে গেছে। কীভাবে সম্ভভ! এখন বলছি, কি আছে এই ১২ মিনিটের ভিডিওটিতে।

 

এক মেয়েকে উন্মুক্ত জায়গায় ধূমপান করতে দেখে একজন মা অবাক হয়ে তাকে ভর্ৎসনা করতে থাকেন। পাশে বসে থাকা এক যুবক মা`র এই বিরক্তি ও ঘৃণা দেখে কিছুটা বিব্রত হয়। পরবর্তীতে ধূমপানরত বন্ধুদের সাথে এক যুবক আড্ডা দিতে গিয়ে উন্মুক্তভাবে এক মেয়েকে ধূমপান করতে দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। এ দৃশ্য দেখে তার মনে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। সে নিজেও একটি সিগারেট ধরিয়ে (অনিয়মিত ধূমপায়ী হিসেবে) বন্ধুদের কথায় কর্ণপাত না করে মেয়েটির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।

 

উন্মুক্ত জায়গায় ধূমপানের অভিযোগে সে মেয়েটিকে শাসাতে থাকে। যুবকটি মেয়েটিকে কোনও আবদ্ধ জায়গায় গিয়ে ধূমপান করার জন্য পরামর্শ (অনেকটা আদেশ) দেয়। নানা খোঁড়া যুক্তিতে সে মেয়েদের সমধিকারের বিপক্ষে যুক্তি দেখায়। মেয়েটিও তার সপক্ষের যুক্তি দেখাতে থাকে। কিন্তু সবমিলিয়ে নির্মাতা প্রটোগনিস্ট হিসেবে এই যুবককেই দাঁড় করান। আর মেয়েটিকে অ্যান্টাগোনিস্ট হিসেবে।

 

যাহোক, সামাজিক নৈতিকতার বিচারে উন্মুক্ত জায়গায় নারীর ধূমপানের কোনও অধিকার নেই, এটাই এ ভিডিওর উপজীব্য। লেখক বা নির্মাতার মতে, নারীরা আবদ্ধ জায়গায় ধূমপান করবে, আর পুরুষরা যেকোনও জায়গায়। নিজেকে আধুনিকমনা বুঝাতে নির্মাতা নারীদের এতটুকু ছাড় দিয়েছেন যে, নারীদের ধূমপানে তার কোনও আপত্তি নেই।

 

নির্মাতার ধারণার গোড়ায় যে গলদটি রয়েছে, সেটা হচ্ছে নারী এবং পুরুষের ধূমপান করার উদ্দেশ্য অভিন্ন নয়। তারমতে, নারীরা ধূমপান করে স্মার্টনেস শো করার জন্য, কিন্তু ছেলেরা কেন করে তা তিনি স্পষ্ট করেননি। তবে ছেলেদের যেকোনও জায়গায় ধূমপানের বৈধতা তিনি দিয়েছেন। তার এই বক্তব্যটি দেশের প্রচলিত আইনের সম্পূর্ণ বিপরীত। প্রথমত, উন্মুক্ত বা আবদ্ধ যে কোনও পাবলিক প্লেসে ধূমপান শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

 

সে নারী বা পুরুষ যেই হোক না কেন। দ্বিতীয়ত, নারী ও পুরুষের মধ্যকার বৈষম্য তুলে ধরতে গিয়ে তিনি নারীর সাংবিধানিক অধিকারের বিপক্ষে হেঁটেছেন। তৃতীয়ত, নারীদের ধূমপান করার দৃশ্য ভিডিওতে ধারণ করে তা অনলাইনে প্রকাশ করতে উৎসাহ জুগিয়েছেন। ফলে এটা নারীদের স্বভাবিক জীবনযাপনের স্বাধীনতায় বিঘ্ন ঘটাতে এবং ঘৃণা থেকে সৃষ্ট অপরাধ (Hate Crime) বাড়াতে অনেকটা প্রভাবিত করবে।


মূলত আধুনিকতার দোষে মেয়েদের দোষী সাব্যস্ত করে বানানো এ ভিডিওটি মধ্যযুগীয় কায়দায় নারীদের শোষণের একটি হাতিয়ার ছাড়া কিছু নয়। মত প্রকাশের স্বাধীনতার দোহায় দিয়ে নির্মাতা পার পাবেন না। কেননা এখানে সামাজিক বৈষম্য, ঘৃণা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির উপাদান ছাড়াও বেআইনি কিছু কাজ করার জন্য উৎসাহ দেয়া হয়েছে। এ ধরণের ভিডিও ‘ভাইরাল ব্যবসা’ বন্ধ করতে দেশের প্রচলিত আইনিই যথেষ্ট। কেউ মামলা করলে ফেঁসে যেতে পারে এ ধরণের আরও অনেকে ভিডিও নির্মাতা।তবে ভাবনার ভিত্তি মজবুত হলে সাধুবাদ পাবার মতো একটি কাজ হতো এ ভিডিওটি। আগামীতে আরও ভালো কনসেপ্ট এবং স্ক্রিপ্ট আশা করছি।"

 

এমন ধারণা রাখেন অনেকেই, অনেকেই স্ট্যাটাসে ক্ষোভ প্রকাশ করেন এ ধরণের বৈষম্যমূলক ভিডিও নির্মাতার বিরুদ্ধে। কেউ কেউ মামলা করার কথা বলেছেন। অবশেষে নির্মাতা সরিয়ে নেন ভিডিও তার ইউটিউব চ্যানেল থেকে। এহেন নির্মাতাদের বিরুদ্ধে এ ধরণের প্রতিবাদ জারি রাখা জরুরি। ফ্রিডম অব স্পিচের নামে এ ধরণের নিম্ন-মানের কাজ মেয়েদের বিরুদ্ধে হেট-ক্রাইম এবং বৈষম্য আরও বাড়াতে পারে, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দৃষ্টি রাখবে বলেই সকলের প্রত্যাশা।