আক্রান্ত | সুস্থ | মৃত | |
---|---|---|---|
বাংলাদেশ | |||
বিশ্বব্যাপী |

আবু তাহের সরফরাজের প্রবন্ধ ‘পৃথিবীর জন্মকথা’
শেষ পর্ব
প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২৬, ২০২১
উত্তপ্ত বাষ্পের একটি গোলক থেকে কিভাবে পৃথিবীর বর্তমান আকার তৈরি হলো, তা বুঝতে হলে পদার্থের মূল উপাদানগুলোর বিষয়ে ধারণা থাকতে হবে। এক বা তারচে বেশি মৌলিক পদার্থ একসঙ্গে মিলিত হয়ে তৈরি করে যৌগিক পদার্থ। আবার, মৌলিক ও যৌগিক পদার্থ একসঙ্গে মিলিত হয়ে তৈরি করে মিশ্র পদার্থ। যৌগিক পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণাকে অণু বলে। দুই বা তারচে বেশি মৌলিক পদার্থের পরমাণু একসঙ্গে মিলিত হয়ে যৌগিক পদার্থের অণু তৈরি হয়। অণু ভাঙলে একই বা আলাদা মৌলিক পদার্থের পরমাণু পাওয়া যায়। পদার্থের ধর্ম ঠিকঠাক রেখে অণু স্বাধীনভাবে অবস্থান করে, তবে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে না। রাসায়নিক বিক্রিয়া এমনই এক কারবার, যেখানে একটি বা তারচে বেশি পদার্থ নিজের ধর্ম বদলে আরেক কোনো পদার্থে নিজেকে বদলে ফ্যালে। এ কর্মটি অণুর একার কাজ নয়। তাই রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশ নেয়ার আগে অণুকে ভেঙে পরমাণুতে ভাগ করে নিতে হয়।
কোনো মৌলিক পদার্থকে ভাঙতে ভাঙতে যদি এমন সূক্ষ্ম কণা পাওয়া যায়, আরও ভাঙতে গেলে যার অস্তিত্বই আর থাকে না, তাকে ওই পদার্থের পরমাণু বলে। কথাটা এভাবেও বলা যায়, মৌলিক পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণাই পরমাণু। প্রতিটি মৌলিক পদার্থ তার নিজস্ব পরমাণু দিয়ে তৈরি। পরমাণু ওই পদার্থের ধর্ম মেনে চলে এবং রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে। যেটা অণুর পক্ষে সম্ভব নয়। অণু যেরকম স্বাধীনভাবে অবস্থান করে, পরমাণু আবার সেটা পারে না। পরমাণু একটা আরেকটার সঙ্গে মিলিত হয়ে অণু তৈরি করে। অণু মুক্ত অবস্থায় থাকতে পারে।
পরমাণুর মাঝের অংশ বা কেন্দ্রকে নিউক্লিয়াস বা কেন্দ্রীণ বলে। পরমাণুর তিনটি ক্ষুদ্রতম কণা রয়েছে। এগুলো হলো: ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন। ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসের চারদিকে কক্ষপথে ঘোরে এবং ঋণাত্মক চার্জ বহন করে। ঘোরার এই পথটা বৃত্তাকার। মুরগির ডিম বসিয়ে তার চারদিকে পেনসিল দিয়ে দাগ টানলে যে রকম গোল আকার হয়, সে রকমও হতে পারে। ইলেকট্রন ও নিউক্লিয়াসের মাঝখানে কিছুটা ফাঁকা জায়গা রয়েছে। প্রোটন ও নিউট্রন নিউক্লিয়াসের ভেতরে অবস্থান করে। প্রোটন ও নিউট্রনের সংখ্যা প্রায় সমান। তবে কোনো কোনো মৌলিক পদার্থের পরমাণুর নিউক্লিয়াসে প্রোটনের চেয়ে নিউট্রনের সংখ্যা সামান্য বেশি থাকে। প্রোটন ধনাত্মক চার্জ বহন করে, আর নিউট্রন চার্জ নিরপেক্ষ। মানে, নিউট্রনে কোনো চার্জ নেই। প্রোটন ও ইলেকট্রনের সংখ্যাও পরমাণুতে সমান। ইলেকট্রন ঋণাত্মক আর প্রোটন ধনাত্মক চার্জ বহন করে বলে পরস্পরকে ছেড়ে এরা বেরিয়ে যেতে পারে না। এদের মধ্যে একটা টান থাকে। এ টানকে বলে, বৈদ্যুতিক টান।
বিদ্যুতের নিয়ম অনুযায়ী, ধনাত্মক চার্জ ও ঋণাত্মক চার্জ সমান হলে দুটোতে কাটাকাটি হয়ে গিয়ে বিদ্যুতের পরিমাণ শূন্য হয়ে যায়। যেমন ৭-৭=০। সুতরাং, পরমাণুতে ইলেকট্রন ও প্রোটন সংখ্যা সমান থাকায় ঋণাত্মক ও ধনাত্মক বিদ্যুতে কাটাকাটি হয়ে গিয়ে ফলাফল হয় শূন্য। মানে, স্বাভাবিক অবস্থায় পরমাণু থাকে চার্জ নিরপেক্ষ।
আকার, আয়তন ও ওজনের ভিত্তিতে পদার্থকে তিন অবস্থায় প্রকৃতিতে পাওয়া যায়। কঠিন, তরল ও বায়বীয় বা গ্যাসীয় অবস্থা। পদার্থ কঠিন, তরল নাকি বায়বীয় অবস্থায় থাকবে তা নির্ভর করে পদার্থের অণুগুলা কিভাবে সাজানো, এদের মধ্যে বন্ধন কেমন, তার ওপর। পানি তরল পদার্থ। এ অবস্থা ছাড়াও প্রকৃতিতে পানি কঠিন ও বায়বীয় অবস্থায় থাকে। একখণ্ড বরফ ফ্রিজ থেকে বের করে রেখে দিলে ধীরে ধীরে সেটা গলে পানি হয়ে যায়। আবার, তাপে পানি ফোটালে তা বাষ্প হয়ে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। বাষ্প হচ্ছে পানির বায়বীয় অবস্থা। বাষ্প ঠাণ্ডা হলে পানি হয়ে যায়। এটা পানির তরল অবস্থা। আর বরফ হচ্ছে পানির কঠিন অবস্থা। পানি অনেক বেশি ঠাণ্ডা হলে বরফ হয়ে যায়। পদার্থের এই তিন অবস্থায় অণুগুলোর একটার আরেকটার সাথে বন্ধন ভিন্ন ভিন্ন হয়। কঠিন পদার্থের অণুগুলো যতটা সম্ভব পরস্পর কাছাকাছি স্থিরভাবে অবস্থান করে। এ কারণে কঠিন পদার্থের নির্দিষ্ট আকার ও আয়তন থাকে। এবং ঘনত্ব সবচে বেশি। তরল অবস্থায় পদার্থের অণুগুলো কাছাকাছি থাকলেও তাদের চলাচল করার জন্য অণুগুলোর মাঝখানে অল্পকিছু খালি জায়গা থাকে। বায়বীয় অবস্থায় পদার্থের অণুগুলো পরস্পর আকর্ষণ শক্তি হারিয়ে একে অন্যের থেকে বেশ দূরে অবস্থান করে। এ কারণে অণুগুলো দ্রুতগতিতে ইচ্ছেমতো চলাচল করতে পারে। বায়বীয় পদার্থের নির্দিষ্ট কোনো আকার নেই। যেখানেই রাখা যায়, দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণত বায়বীয় পদার্থে অণুর গতি প্রতি সেকেণ্ডে প্রায় দুই থেকে তিন মাইল। এই গতির বেগ নির্ভর করে বায়বীয় পদার্থের তাপের ওপর। কোনো বদ্ধ পাত্রে বায়বীয় পদার্থের অণুগুলো চারদিকে ছুটোছুটি করতে থাকে এবং পাত্রের গায়ে এসে অবিরাম ধাক্কা মারতে থাকে। এই ধাক্কার চাপকে বলে বায়বীয় চাপ।
অণুর অবস্থান বা দূরত্ব, গতি ও আকর্ষণের ওপর যদি পদার্থের অবস্থা নির্ভর করে তাহলে বাইরে থেকে অণুর অবস্থানের পরিবর্তন ঘটাতে পারলে পদার্থের অবস্থারও পরিবর্তন হবে। পানি তরল পদার্থ। পানিকে ঠাণ্ডা করলে বরফ হয়। আবার তাপ দিলে জলীয় বাষ্পে পরিণত হয়। হাইড্রোজেনের দুটো পরমাণু ও অক্সিজেনের একটি পরমাণু একসঙ্গে মিলিত হয়ে তৈরি হয় পানির একটি অণু। তরল, কঠিন কিংবা বায়বীয় অবস্থায় পানির মূল উপাদানের কিন্তু কোনো পরিবর্তন হয় না।
দ্যাখা যাচ্ছে, তাপের ভিন্ন ভিন্ন পরিমাণ থেকে পদার্থ তিন অবস্থায় প্রকৃতিতে থাকে। সোনা ও লোহার মতো ধাতুও সূর্যসহ অসংখ্য নক্ষত্রে তীব্র তাপের কারণে বায়বীয় বা গ্যাসীয় অবস্থায় রয়েছে। উত্তাপ পেলে কঠিন পদার্থ প্রথমে তরলে পরিণত হয়, এরপর আরও উত্তাপ পেলে সেই তরল পরিণত হয় বাষ্পে। আবার, বায়বীয় পদার্থ উত্তাপ পেলে প্রথমে পরিণত হয় তরলে, এরপর কঠিন পদার্থে। জমে ওঠা কতগুলো বায়বীয় পদার্থ শীতল করা হলে সেই পদার্থের কোনো অংশ জমে গিয়ে হয়তো তরল হবে, বাকি অংশ থাকবে বায়বীয় আকারে। বিভিন্ন বায়বীয় অণুর বিন্যাস একরকম নয়। তাই একই অবস্থায় থাকলেও তাদের আচরণ হয় ভিন্ন ভিন্ন। এ কারণে বায়বীয় অবস্থায় পৃথিবী সৃষ্টিপর পর অনেক পদার্থ জমে গেল তরল হয়ে, আর অনেক পদার্থ রয়ে গেল বায়বীয় আকারেই। অক্সিজেন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন, হিলিয়াম, আর্গন প্রভৃতি মৌলিক পদার্থ এখনো পর্যন্ত বায়ুমণ্ডলে বায়বীয় অবস্থাতেই রয়ে গেছে। অবিরাম উত্তাপ ছড়িয়ে দিয়ে পৃথিবী বর্তমানে যে শীতল অবস্থায় এসে পৌঁছেছে, তাতে এসব বায়বীয় পদার্থের অণুগুলোর বিন্যাস এতটা পরিবর্তন হয়নি যাতে তারা তরল আকার পেতে পারে। পৃথিবীর সৃষ্টির কোটি কোটি বছর পর আজও তাই গ্যাসীয় মৌলিক পদার্থগুলো বায়বীয় অবস্থাতেই রয়ে গেছে।
পৃথিবী যখন উত্তপ্ত বাষ্পের গোলক ছিল, তখন তা একটা ক্ষুদ্র সূর্যের মতো উত্তাপ ও আলো বিকিরণ করতো। উত্তাপ ও আলো বিকিরণের ফলে একটা সময়ে পৃথিবীর উত্তাপ কমতে থাকে। পৃথিবীতে এই পরিবর্তন যখন চলছে, তখন এক মুহূর্তের জন্য পরিবর্তন থমকে যায়নি। লাটিমের মতো বনবন করে পৃথিবী সূর্যের চারদিক ঘুরছিল, আর সূর্য তাকে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বলে নিজের দিকে সজোরে টেনে ধরে ছিল। মনে হতে পারে, এই আকর্ষণে পৃথিবীর জলীয় বাষ্প সূর্যের দিকে ছুটে গেছিল। আসলে কিন্তু তা নয়। কারণ, অবিরাম ঘোরার ফলে পৃথিবীর কোনো দিকই বেশি সময়ের জন্য সূর্যের দিকে থাকতে পারেনি। এতে সেই আকর্ষণও নির্দিষ্ট কোনো জায়গার ওপর তেমনভাবে কার্যকর হয়নি। তবে প্রবল স্রোতের সৃষ্টি হতো, যা পৃথিবীপৃষ্ঠ প্লাবিত করতো। চাঁদ ও সূর্যের আকর্ষণে এখনো সমুদ্রে জোয়ার আসে। পানি উথলে ওঠে। পৃথিবীতে প্রথম যে জোয়ার এসেছিল তা শীতল জলের স্রোত ছিল না। ছিল উত্তপ্ত রক্তবর্ণ গলিত ধাতব পদার্থের স্রোত। আগ্নেয়গিরির মুখ থেকে বের হয়ে এটা জমে কঠিন না হওয়া পর্যন্ত প্রবল স্রোতের বেগে পৃথিবীর ওপর দিয়ে বয়ে গেছিল। শীতল হয়ে এই স্রোতই পরে পাথরের কঠিন স্তরে পরিণত হয়। পৃথিবীতে জলময় সমুদ্র সৃষ্টির অনেক আগেই এই স্তরের উৎপত্তি হয়েছিল।
সে সময় পৃথিবীর উপরিভাগ এতই উত্তপ্ত ছিল যে, সমুদ্রের বিপুল জলরাশি বাষ্প হয়ে সবসময় বায়ুর সঙ্গে মিশে থাকত। সুদূর আকাশের মেঘপূর্ণ বায়ু থেকে সেসময় গরম জলের বৃষ্টি হতো। কিন্তু তা পৃথিবী পর্যন্ত পৌঁছতে পারতো না। কেননা তা পৃথিবীর উত্তপ্ত স্তর স্পর্শ করার আগেই পুনরায় বাষ্প হয়ে যেত। সেই স্তরই কালক্রমে কঠিন হয়ে আদি স্তরে পরিণত হয়। পৃথিবীর এই অবস্থাতে পৃথিবী থেকে চাঁদের উৎপত্তি হয়। পৃথিবীর আবর্তনের সময় যেসব ধাতব পদার্থ মাধ্যাকর্ষণের টানে পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছিল, তা থেকেই চাঁদ তৈরি। কোনো জিনিস যদি একটি কেন্দ্রের চারদিকে অবিরাম ঘুরতে থাকে, তবে সেই জিনিসের মধ্যে কেন্দ্র থেকে বাইরে ছিটকে যাবার একটা টান তীব্র হয়ে ওঠে। ঘোরার বেগ যত বাড়ে, সেই টানও তত তীব্র হতে থাকে। বায়বীয় অবস্থায় ঘোরার বেগ যদি খুব বেশি হয় তাহলে এই টানের প্রভাবে বাষ্পপিণ্ডের ওপর থেকে ছোট ছোট টুকরো এদিক-ওদিক ছিটকে পড়ে। এই টুকরোগুলো বাষ্পপিণ্ডের মাধ্যাকর্ষণ শক্তিসীমার বাইরে যেতে পারে না। তখন তাকে কেন্দ্র করে তার চারদিকে টুকরোগুলো ঘুরতে থাকে। পৃথিবী থেকে চাঁদের জন্ম এভাবেই হয়েছিল।
পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া গলিত ধাতব পদার্থ চাঁদের বিশেষ কোনো আকার ছিল না। বিচ্ছিন্ন হওয়ার সাথে সাথেই তা ঘুরছিল। পরে ধীরে ধীরে শীতল হতে থাকে। এ সময় এর সকল অংশ পরস্পর পরস্পরকে ভেতরের দিকে আকর্ষণ করায় এটা ক্রমশ গোল আকার ধারণ করে। তখন চাঁদ পৃথিবীর খুব কাছে ছিল। পরে আস্তে আস্তে দূরে চলে যায়। চাঁদের উৎপত্তি হওয়ার পরও পৃথিবীর উত্তাপ ধীরে ধীরে কমছিল। এখনো তা কমেই চলেছে।