কাজী জহিরুল ইসলামের আত্মগদ্য ‘আমার বিচিত্র জীবন’

দিদিমা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। খুব সামনে থেকে আপনজনের চলে যাওয়ার সাক্ষ্য বহন করার অভিজ্ঞতা সেই প্রথম। তখন মৃত্যু সম্পর্কে সম্যক সচেতন, অথচ দেখি যে, মানুষটি বেঁচে থাকার জন্য হাত বাড়াতে চাইছিল; সেই হাত ধীরে ধীরে বালিশের ওপর লুটিয়ে পড়লো নিস্পন্দ।

জীবনের কিছু চরিত্র আছে, যা তাদের গল্পের ইতি না টেনেই হারিয়ে যায়। কিছু অনুভূতি মানুষকে তার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করে, তখন সম্পর্কগুলো ফাঁপা কলসের মতো ঠো-ঠো শব্দে বাজতে থাকে! 

কলেজে ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে আমার বেশিরভাগ সময় কাটতো লাইব্রেরিতে এবং গঙ্গার ধারে। সে সময় আমার নিজের ভেতর ডুব মেরে বসে থাকা স্বভাবটি গভীরতম অন্তর্দশায় ছিল। ক্লাসের মধ্যে শান্ততম মেয়েটি যার নাম ছিল সিমি, বরাবর আমার পাশে বসতো।

এই পৃথিবীতে কাউকে ভালোবাসাটা সবচেয়ে বড় অপরাধ। যেই মানুষটাকে তুমি খুব ভালোবাসবে তাকে ছাড়া তুমি বাঁচতে পারবে না, আর তার সাথে কেউ তোমাকে বাঁচতে দেবে না। কী আশ্চর্য, না?

তখন বারো ক্লাস। ক্লাসরুম সংলগ্ন বারান্দায় এসে মাঝে মাঝে দাঁড়াতাম একা একা। চোখের ওপর রোদ এসে পড়তো। খেয়ালি পাখির মতো আপন মনে হয়তো গাইতাম টিফিনবেলার নিজস্ব স্বরলিপি। হঠাৎ একদিন খেয়াল করলাম, ঠিক উল্টোদিকের বারান্দায় আমার সোজাসুজি দাঁড়িয়ে আছে ভীষণ সুন্দরী একটি মেয়ে।

কোনোমতে উঠে বীথির বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। রাতের ছাড়া ছাড়া আধো ঘুমের স্বপ্নগুলো মাথায় বারবার খোঁচা দিয়ে যাচ্ছে। কখনো দেখছি বীথি ভীষণভাবে কান্নাকাটি করছে। কী নিয়ে এত কান্নাকাটি, সেটা বুঝলাম না। কখনো দেখছি, বীথি কোথাও চলে যাচ্ছে। আমি কোনোমতে ওকে আটকাতে পারছি না।

বীথিদের বাসা থেকে যখন বের হচ্ছি তখন ৯টা বাজে। আজ বীথির বান্ধবীরা কেউ ওর সাথে থাকবে না শুনে আমার কেমন জানি ভয় ভয় লাগল। কিন্তু করার কিছু নেই। বীথি কোনোমতে আর কাউকে ওর সাথে থাকতে দেবে না। ওর সাফ কথা, ও নাকি পুরোদমে সুস্থ এখন। এই মেয়েটাকে যে কেমন করে বুঝাই!

আমি ভেবেছিলাম, আমার কোনো বন্ধু বীথির সাথে বাঁদরামি করার জন্য বা আমার সাথে ঝগড়া বাঁধিয়ে দেয়ার জন্য কল করেছে। এক-একটা যে হারে বদমাইশ, একটারেও বিশ্বাস নাই। কিন্তু কল লিস্টে যে নামটা দেখলাম সেটা দেখব স্বপ্নেও কল্পনা করিনি। বাবা! বাবা বীথিকে কল করেছিলেন? বাবা? কিন্তু কেন? কি বলেছেন?