অরূপ রাহীর একগুচ্ছ কবিতা

প্রকাশিত : আগস্ট ১৯, ২০১৯

গেরিলা বসন্ত

আবার আমের বোল
আইসা পড়ল উর্দি ফাঁকি দিয়া আমার
ব্যক্তিগত আর্মি ফাঁকি দিয়া
ব্যক্তিগত আর্মি আহা
বসে থাকে ঠাঁয়
মন কোথা ধায়
বাঁশি বাজে ফুর ফুর ধ্বনি
নাপিতাসে, চুল কাটে
জুতা পালিশের ছলে
আমি তার গাছগুলা গুনি

আমি মুচির বেটা মুচি
আমি শীলের বেটা শীল
আমি বুয়ার বেটি বুয়া
সাপোর্ট সার্ভিস কর্পোরেট হবে
বুয়া টুয়া নাহি রবে
টাই পরে শীল কাটবে চুল
মুচির বেটা নাহি পাবে কূল

তবু এই সেপাইয়ের
আর তার বসেদের
বিরহ বেদনার মতো
বিউগল বাজানোর বেলা
জীবনের অবহেলা সয়ে যাব
আমের মুকুল।

গেরিলা বসন্তের আমি বনফুল

গেরিলা বসন্তের আমি বনফুল
ঠিকঠাক ফুটে উঠি না করিয়ে ভুল
নদী বন পাহাড়ে সমতলে যাই
শহর-নগর-রাজ-পাট বাকি নাই
রাইফেলে গ্রেনেডে পাপড়ি ফোটাই
(শত) সহস্র বিমানের পাখনা গজাই
যদি দেখি ইতিহাস থমকায়ে রয়
ঘটনা ঘটায়ে দিতে কর্তার হয়।
শহর-নগর জুড়ে আমার সুবাস
রক্তে ফাগুন নাচে রক্তবিলাসফুলে
বাসর সাজায়ে চলি পরমের স্বাদ
নিয়ে ইতিহাস জেগে ওঠে করিয়ে নিনাদ
গেরিলা বসন্তের আমি বনফুল
গেরিলা বসন্তের আমি বনফুল

হোলি

টেলিফোনে আড়ি। চল দেখা করি।
মেতে উঠি ষড়যন্ত্রের খেলাতে।
বোমা ফেটে যাবে— সাবধানে যাবে
গ্রেনেডের ডালা রেখো সুযতন করি।
তোমার দুচোখ, কাটা বন্দুক
কাজলের টান দিয়া কামোফ্লেজ দিও।
আমার রুমাল ফুল সুবাসের
রাং দেয়া, অই দিয়া কক্টেল নিও।
লুটেরার দল, দিল রসাতল
জনতার স্বপ্ন, জীবনের স্বাদ।
ক্ষমতার মানে অরা না কি জানে
আমরাও কিছু কিছু করছি আবাদ।
বাসনা জাগাও, চাপা রাখিও না
জোরে বলো তার পথে বাধা কি কি আছে
কি বাসনা বাঁধে মানুষেরে প্রেমে
তার উড়াও পতাকা উঁচা উঁচা গাছে।
এ বাসনা খোলা, মুক্ত, স্বাধীন
তোমার আমার সাথে মোকাবেলা চাই
কামে-ঘামে-নামে, রক্তে ও প্রেমে
জীবনের ময়দানে হোলিখেলা চাই।

দুনিয়া

এত গাড়ি, এত এত উঁচা উঁচা, কাচ ঘেরা দালান! দালান! কেমনে বানায়!
এত মানুষের ভিড়! এত মার্কেট! শপিং মল!
বিদেশি খাবারের দোকান! পিৎজা হাট। বড়লোকে খায় অইখানে?
ওইযে দেখলাম জামাল ভাইয়ের মতো যায়
অইযে দেখলাম মোমেনা আপার মতো যায়।
অনেক। গার্মেন্টসে কাম করে।

আর কত প্যান্ট পরা লোক! কত কত মহিলা রাস্তায়!
কালো কাচে ঘেরা কত গাড়ি কইরা কারা কারা যায়?

অইযে শিশু পলাপাইন! আমার বয়স। বস্তিবাসী নিশ্চয় এরা!
অইযে সংসদ! অইখানে ঝগড়া-ঝাটি হয়। নেতারা মুখ খারাপ করে।
আল্লাহ! এত বড় রাস্তা! এত বড় শান করা মাঠ! এরে কয় পার্ক!
এত আলো! এত অন্ধকার!

সবই আগে দেখছি টিভিতে। এই প্রথম বস্তজ্ঞানে দেখা! এই দেখা আসল আসল।
কেমনে হয় এমন শহর? রাজধানী?
ওইযে শাপলা! এত বড়!
ওইযে ঝর্ণা! হা হা হা, শুকনায় ফোয়ারা দিছে!
অইযে বায়তুল মোকাররম!
আল্লাহ! একবার সেজদা দিতে চাই! একবার তোর নাম ডাকব এইখানে বুক ভরে!
মাকে গিয়া বলব আমি তার জন্যে হাত তুলছি
বায়তুল মোকাররমে গিয়া!
বাপের জন্যে টুপি নিব। মাকে দিব জায়নামাজ। ছোট বইন সালমারে
নিয়া দিব ফাতেমা জীবনী!
টাকা হবে এত! এত টাকা কই পাব আমি!
লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে থাকি। মায়-বইনে খায় কীনা খায়।
এত গাড়ি, এত বাড়ি, এত এত খাবার দোকান, জুয়েলারি!
এত এত শপিং দালান! মানুষের এত এত টাকা আসে কই থিকা, খোদা?
আমার তো টাকা নাই।
খোদা, যদি তোর রহমতে, আমার পকেটে আসে কয়টা মাত্র টাকা! যদি আসে!
ফাতেমা জীবনী যদি নিতে পারি!
বাপ-মারে কিছু দিতে পারি!

খোদা! সব ঝাপসা লাগে কেন! খোদা! এত অন্ধকার কেন?
খোদা! আমি কই যাইতেছি! খোদা আমি মার কাছে যামু!
খোদা আমার আব্বা ডাকে মোরে! খোদা আমার সালমা বইন ডাকে!

খোদা আমি রাস্তা পার হই!
খোদা আমি তোর নামে কই—
দুনিয়াটা মস্ত এক ঈমান আর বেঈমানি খেলা!
মরণের আগে যদি পাই তার আরও একবেলা,
জগতের ইনসাফ জগতেই দিও তুমি প্রভু!
তোমার নিরানব্বই নাম, এ জনমে ভুলি নাই কভু!

ভোর

ভোরের মতন কোনও ভোর হয় না কি, জীবনের?
গোষ্ঠে চলে হরি মুরারি, হাসপাতালের পাশে চা দোকানে ভিড় লেগে যায়?
লাশ নিয়া নদীপারে পৌঁছে দিয়ে আসে ঢেউগুলা?

আমাদের রাস্তাগুলা পীচঢাকা বলে লাফারুর আনাগোনা কম।
তা না হলে আসত হরিণ।
সংসদে বসে তারা রামপাল বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট কণ্ঠ ভোটে পাশ করে দিত।
দিত কি না? তুমি কিন্তু জানো, কিন্তু বলতেছ না।

না বলো।

আমি আজ ভোরেকার বেলা চা খামু গো হরি মুরারি,
গ্রীন রোড পার হয়া, পাঁচ নাম্বারে।
ফজর ঘুমায়ে পার করলা যে, পার হবা কেম্নে, বলো?

এই নেও, চিনি কম, লাল চা। খাও।

কফি

এক.
আমি কবিতা না লেইখা কফি খাইতেছি এই সকালে,
নশ্বরতা কত যে মজার, রাধে-শ্যাম!
না পাওয়ার বেদনার মতো,
পাইয়া হারানোর মতো,
আর কত পাইয়া নিয়া মজা, রাধে-শ্যাম!
বিরহ-বিভোর রাত, আন-বাড়ি-ভোর রাত,
স্মারটনেসে ভাইস্যা যাওয়া চিন-চিন ব্যথা, রাধে-শ্যাম!

তা তুমি তো বলবাই,
মজা নিয়া মজাক্কারি করো, রাহী,
তুমি বটে ফাজিল চিড়িয়া
আমি কিন্তু তোমারেই যুগলে-মুগল নিয়া
চুড়ান্ত বিলা-টিলা হয়া,
কফির দাওয়াত দিছি, রাধে-শ্যাম!

তুমি বলবা, ফাইজলামি রাখো,
খালি পেটে কফি কেন খাও?
আমি কই, তুচ্ছ অতি সেকারণে নাই ক্ষতি,
নশ্বরতা লভি, রাধে-শ্যাম!

ছন্দ-ফন্দ না বুঝিয়া,
গুরু-চণ্ডালি নিয়া,
শাক্ত মতে বাগেন্দ্রিয়ে
কালিমা কালিমা পড়তেছি, রাধে-শ্যাম!
আমি কবিতা না লেইখ্যা,
এফিমেরালিটি নিয়া মজা মারতেছি, রাধে-শ্যাম!

তারপরে ধরো এই
জগতে যে যন্ত্রণা আছে, তন্ত্রণা আছে,
না খাওয়ার কষ্টও যে আছে,
চুতিয়ারা এইগুলা দেইখা,
আমার মতোই, কফি খাইতেছে রাধে-শ্যাম!
লিবারাল আছে, ইয়ো-ইয়ো-ইয়োগারা আছে,
ওরাও কফির মজা মারতেছে, আমারি মতন, রাধে-শ্যাম!
আমি কিন্তু কিছু কই নাই অগো, রাধে-শ্যাম!

আমি একটু বোকাচোদা আছি,
ঘৃণা-লজ্জা-ভয়ে আছি,
কবিতাটা ছাড়তেছি মাত্র, রাধে-শ্যাম!

দুই.
কোনো একদিন আমি
চরাচরে ট্রাফিক মাস্টার
হয়ে যাব তারাদের মাঝে
তুমি কিন্তু ভেঁপু বাজায়ো না
নীরবতা জ্বলে উঠে দেখাইবে পথ।

কোনো একদিন আমি
চুপ করে
নাগারজুন কফিশপে
অপেক্ষায় থাকব তোমার
চরাচরে
ছেড়ে দিয়ে ট্রাফিকের কাজ।

তারা-নক্ষত্রের সাথে এত কেন ছোটাছুটি, বলো?
ক্লিশে কবিতার ফর্ম কফিতে মিশায় কেডা, বলো?