আসুন বোলানিয়োকেও পড়ি

হামীম কামরুল হক

প্রকাশিত : আগস্ট ১২, ২০২১

আমার প্রিয় লেখক ও প্রিয় বইপত্রের কোনো শেষ নেই। প্রায় ছোটবেলা থেকে বুঝে না বুঝে বইপত্র পড়েছি। দিন কতক আগে বিশ্বনাথ রায়ের ‘পাঠক রবীন্দ্রনাথ’ বইটা পড়তে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কথাটা তাই খুব মনে ঘাই দিল। আরে তাই তো, পাঠক তো এভাবেই পড়ে! এই বুঝে না-বুঝে পড়া ছাড়া বইপড়াটাই চালু রাখা যেত কিনা সন্দেহ। রবীন্দ্রনাথের কথাটি ছিল, একধার হইতে বই পড়িয়া যাইতাম; যাহা বুঝিতাম এবং যাহা বুঝিতাম না দুই-ই আমাদের মনের উপর কাজ করিয়া যাইত।

কথাটিকে বিশ্বনাথ রায় বিশ্লেষণ করলেন এই বলে যে, এতে দুটো কাজ হতো। এক. এই একটার পর একটা বই পড়তে পড়তে তাঁর ব্যক্তিত্বে পড়ার অভ্যাস গড়ে ওঠা। দুই. সারাজীবন ধরে এই পড়ার অভ্যাস বজায় রাখায় তা কবি মনের ওপর সীমাহীন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছিল যা তার ভেতরে নিত্য নতুন সৃষ্টি ও উদ্ভাবনের পথ করে দিয়েছিল।

আরেকটি গভীর ব্যাপার মনে হয় অনেকেই টের পান, তাহলো পড়ার আকাঙ্ক্ষা মানুষের আয়ু বৃদ্ধি করে। একটি বই পড়তে শুরু করলে তাতে যদি মেতে ওঠা যায়, তাহলে প্রতিনিয়ত নিত্যনতুন বই পড়ার জন্য যে তাড়না মনে বজায় থাকে তা মানুষকে জীবনবাদী করে এবং তার জীবনাকাঙ্ক্ষা বাড়িয়ে দেয়। কদিন আগে পশ্চিমবঙ্গের কবি, গল্পকার এবং ঔপন্যাসিক শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়ের একটি ছোটগল্পে এমন একটা কথা পেলাম, যার মানে হচ্ছে আয়ু মানুষ তার ইচ্ছা মতো বাড়তে পারে, সে যতদিন সুস্থমতো বাঁচতে চায়, সে ততদিন বাঁচতে পারে। দুর্ঘটনার হলে অন্য কথা। সেই আয়ু বাড়ানোর একটি পথ হচ্ছে পড়ার ভেতরে থাকা। একটার পর একটা বই পড়ে চলা। ভারতীয় অলংকারশাস্ত্রে এই পাঠকেই বলা হয় ‘সহৃদয় পাঠক’। পড়লে মন তাজা থাকে, অন্তত ব্যক্তিগতভাবে আমার তো তা থাকেই। বইপড়াহীন দিন রীতিমতো ব্যর্থদিন। তাই বলে বইপোকাও হতে পারিনি। বই যেন আমাকে এও বলে, কেবল বই-ই প’ড়ো না, বইয়ের বাইরের যে জীবন সেই জীবনে যোগ দাও। বহু আগে কার যেন কবিতা পড়েছিলাম ‘জীবনটাই পাঠ্য ছিল’। তবে কেবল জীবনটাকেই পড়লে হবে না, তার সঙ্গে পড়াটাও চাই।

মহাভারতে কর্ণ মনে করতেন, তার অর্জিত বিদ্যাই তার পরিচয়, তার জন্মের সঙ্গে তার সামর্থ্যের কোনো সম্পর্ক নেই। আমার মনে হয়, যেকোনো প্রকৃত পাঠকও এই স্তরে উঠতে পারেন, যেখানে তিনি জগতের সব রকমের বাধাবিপত্তি পাড়ি দিতে পারার সক্ষমতা লাভ করেন। চেশোয়াভ মিউস বলেছিলেন, সেই কবিতা পড়ে কী লাভ যদি তা মানুষকে বাঁচাতে না পারে? মিখাইল শলোখভ মনে করতেন, তার লেখা যদি মানুষকে আরো উন্নতর জীবনের দিকে যাওয়ার প্রেরণা দেয়, তাহলেই তার সার্থকতা।

এই যে পাঠের উপকারের কথা বলছি, তা আয়ু বাড়াবে তখন যদি আমি স্বাস্থ্যবিষয়েও সচেতন হই। সুস্থ জীবনাচরণ তৈরি করতে পারি। যদি অতিরিক্ত ধূমপান মদ্যপান বা স্বাস্থ্যহানীকর কোনো কাজ অভ্যাস থেকে নিজেকে রক্ষা না করতে পারি তো কেবল পড়ার আকাঙ্ক্ষাই কাউকে রক্ষা করবে না। জগতের প্রধান তিন জন লেখক গ্যোয়েটে, তলস্তয়, রবীন্দ্রনাথ কিন্তু আশি বছর বেঁচেছিলেন। বেঁচে থাকার জন্য তাঁদের নিশ্চয়ই কোনো মাস্টারি ছিল, নইলে লেখার মতো স্নায়বিক চাপ গ্রহণ করে সুস্থ সবল ও দীর্ঘায়ু থাকা কোনো সোজা ব্যাপার নয়। এই মাস্টারিটা অনেকের নেই বলেই অসামান্য প্রতিভাসম্পন্ন হওয়ার পর অল্প বয়েছে অনেকে চলে যেতে হয়েছে। যেমন, আজকে যে লেখক ও তার বই নিয়ে কথা বলতে চলেছি, সেই রোবের্তো বোলানিয়ো বেঁচেছেন মাত্র পঞ্চাশ বছর। নিজের বেঁচে থাকা নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে তাঁর ‘শেষ সাক্ষাৎকারে’, জুলাই ২০০৩-এ প্লেবয়ের মেক্সিকো সংস্করণে, মনিকা মারিসতাইনকে বলেছিলেন,আমি এখনও বেঁচে আছি, আমি এখনও পড়ছি, এখনও লিখছি এবং ধুমসে সিনেমা দেখছি।

এরপর তিনি চিলির জাতীয় বীর আর্তুরো প্রাত-এর মন্তব্য যোগ করেছিলেন,‘যতক্ষণ বেঁচে আছি, এই ঝাণ্ডা নিচে নামবে না।’ কিন্তু কে বলতে পারে অত্যাধিক ধূমপানের কারণেই কি তাঁকে অকালে চলে যেতে হলো কিনা। বোলানিয়োর জন্ম ২৮ এপ্রিল  ১৯৫৩ সালে, চিলির সান্তিয়াগোতে মৃত্যু ১৫ জুলাই ২০০৩ সালে। বেড়ে উঠেছিলেন চিলি ও মেক্সিকোতে। অনেকটা সময় ছিলেন স্পেনে। মৃত্যুও হয়েছিল স্পেনের ব্লানেস-এ। প্রথাবিরুদ্ধ কবি ও কথাসাহিত্যিক হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ছিল দেশ থেকে দেশান্তরে। ইংরেজি অনুবাদে তাঁর যে কাজগুলি পাওয়া যায় তার ভেতরে আছে ‘অ্যামুলেট’, ‘বাই নাইট ইন চিলি’, ‘ডিসটেন্ট স্টার’, ‘মাসিয়ো পেইন’, ‘নাজি লিটারেরচার ইন দি আমেরিকাস’,‘দ্যা থার্ড রাইখ’, ‘দ্যা সিক্রেট অব ইভিল’, ‘দ্যা রিটার্ন’, ‘ত্রেস’, ‘দ্যা স্যাভেজ ডিটেক্টেভস’, ‘২৬৬৬’, ‘লাস্ট ইভিনিং অন আর্থ’, ‘দ্যা রোমান্টিক ডগস’ এবং ‘দ্যা স্কেটিং রিঙ্ক’ ইত্যাদি। বলা হয়, লাতিন আমেরিকার সাহিত্যে কয়েকটি স্তম্ভের ভেতরে আছে হুয়ান রুলফো ‘পেদ্রো পারামো’, হুলিও কোর্তাজারের ‘হপস্কচ’,গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সালিচ্যুড’ এবং রোবের্তো বোলানিয়ো-র ‘দ্যা স্যাভেজ ডিটেক্টিভস’। এ থেকে বাঙালি পাঠকরা বুঝতে পারবেন বোলানিয়োর গুরুত্ব।

বোলানিয়ো সৃষ্টিশীল লেখক হিসেবে যত বিখ্যাত হচ্ছিলেন, সেই সঙ্গে টের পাচ্ছিলেন তাঁর নন-ফিকশান বা গদ্যেরও চাহিদাও দিনে দিনে বেড়ে চলেছে। বলতে গেলে, তাঁর জীবনের শেষ পাঁচ বছর (১৯৯৮-২০০৩) তিনি পত্রপত্রিকায় বিভিন্নধরনের গদ্য লিখি চলছিলেন। সেই সব গদ্য একসাথ করে বেরিয়েছিল ‘বিটুইন প্যারানথিসিস’ (২০০৪) বা ‘ব্যাকাংশের মধ্যিখানে’। এটি তাঁর প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও বক্তৃতার সংকলন। যেকোনো সৃষ্টিশীল লেখক লিখতে লিখতে ক্লান্ত বা অবসন্ন হলে নতুন করে লেখার ইন্ধন বা ফুয়েল জোগানোর জন্য বোলানিয়োর এই বইটি পড়তে পারেন। আত্মকথায় শুরু এই বইটি শেষ হয়েছে ঔপন্যাসিকের আত্মতদন্ত দিয়ে।

মোট ছটি ভাগ আছে এই বইতে— ১.থ্রি আনসাফারেবল স্পিচেস, ২.ফ্রাগমেন্টস অব অ্যা রিটার্ন টু দ্যা নেটিভ ল্যান্ড, ৩. বিটুইন প্যারানথিসিস, ৪. সিন্স, ৫. দ্যা ব্রেভ লাইব্রেরিয়ান, ৬, দ্যা প্রাইভেট লাইফ অব অ্যা নভেলিস্ট। শুরুতে আছে আর পুরো বইজুড়ে কে বা কার সম্পর্কে কথা নেই? তবে সবই পাশ্চত্য সাহিত্যের। বোলানিয়ো বারবার বলেন হোর্হে লুই বোর্হেসের কথা। যদি একজন লেখকের সব কিছু পাঠ করার মতো কেউ যদি থাকেন তিনি বোর্হেস। এই বইতেও সমস্ত সাহিত্যিকের ভেতরে সবচেয়ে বেশি বার উচ্চারিত হয়ে বোর্হেসেরই নাম। এই বইয়ের প্রায় সব লেখায় আকারে বিস্তারে ছোট কিন্তু গভীর। তিনি যেভাবে পাঠ করেছেন, সেখানে তাঁর দেখবার কায়দাটা বোলানিয়োর নিজস্ব। তুর্গেনেভ, দস্তয়েভস্কি, তলস্তয়, চেখভকে তিনি এক ভিন্নদৃষ্টিকোণ থেকে পাঠ করেছেন। দ্য প্রাইভেট লাইফ অব অ্যা নভেলিস্টে তিনি তার ‘লিটারারি কিচেন’ বা সাহিত্যের রান্নাঘরে চান খুবই কম জিনিস, তার ভেতরে থাকবে, ল্যাম্প, কিছু বই, সাহসের উবে যাওয়া সুবাস আর সত্য থাকলে আর কিছুই চাই না।

তাঁর মতে, সাহিত্য হলো বাহুল্য থেকে বাহুল্যের বিরুদ্ধ এক দীর্ঘ লড়াই। তিনি বলেন, অন্যরা তাদের সাহিত্যের রান্নাঘরে কী করবেন তিনি জানেন না, কিন্তু তিনি জানেন, তিনি কোনো কুম্ভিলবৃত্তি (প্লেইজারিজম) করবেন না।  সাহিত্য করতে এসে এই লেখাচুরির চোরকে প্রকাশে ফাঁসি দেওয়ার পক্ষপাতি তিনি। ছোটগল্প লিখতে শেখার জন্য এক অ্যাগার অ্যালন পো-কে পাঠ করাই যথেষ্ট বলে তিনি মনে করেন। তিনি মনে করেন, আন্তন চেখভ ও রেইমন্ড কারভার হলেন শতাব্দীর সেরা দুই ছোট গল্পকার। আমরা টের পাই যে, বোলানিয়োর মন্ত্র হচ্ছে: বাঁচো, পড়ো, লেখো, সিনেমা দেখো। আর তাঁর মন্ত্রণা তাঁর অভিমতগুলি জানলেই বোঝা যায়। বোলানিয়োর এই বইতে ছড়িয়ে আছে বিশ্বসাহিত্যের বিচিত্র সব ফুলকি। তদুপরি একটি আক্ষেপ থেকে যায়। বোলানিয়োর মতো এত শিক্ষিত পাঠক প্রাচ্যের ধ্রুপদি সাহিত্য বিশেষকরে ভারতীয় পুরাণ, বিশেষ চৈনিক-জাপানের গদ্যকর্ম, কথাসাহিত্য নিয়ে কোনো কথাই বলেন না, অন্য আরো সবার মতো এটা একালে এসে আমাদের চোখে কাঁটারমতো বিঁধে।

বাংলাদেশে বোলানিয়ো তিনটি অনুবাদ চোখে পড়েছে। এগুলো হচ্ছে: ১. পৃথিবীতে শেষ সন্ধ্যা ও অন্যান্য গল্প— দিলওয়ার হাসান অনূদিত, সংহতি, ঢাকা। ২. রোবের্তো বোলানিওর গল্প— শৌভিক দে সরকার অনূদিত, বেহুলা বাংলা, ঢাকা। ৩.সামান্য স্বৈরিণী— আলীম আজিজ অনূদিত, প্রথমা, ঢাকা।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষক (জাবি)