এহসান হাবীবের ৫ কবিতা

প্রকাশিত : আগস্ট ২১, ২০১৯

ভয়

কিছু কিছু মানুষের দাগকে খুব ভয় ছিল
যদি, দাগ থেকে যায়?
কারো কারো রক্তকে ভয় ছিল
যখন তখন রক্তপাত ঘটে যাওয়ার আশঙ্কা!
কেউ কেউ কাচকে খুব ভয় পেতো
অ্যাস্ট্রের মতো পড়ে গিয়ে যদি ঝনঝন বেজে ওঠে!

তবু এতসব ভয় নিয়ে তারা মৃত্যুকে ভয় পায়নি।

প্রতিবার বলতো,
‘মেরে ফেলো। এইবার আমাকে মেরে ফেলো, প্লিজ।’

জল খলবল

জলের নিচে কী আছে?
কী থাকে জলের নিচে?
অতল?
তবু আলী আলী বলে ঝাপায়ে পড়ে মানুষ।

জলের নিচে কী আছে জানা নেই
হাঙ্গর, কুমির তো থাকতেই পারে।
আছে বিচিত্র রঙের অক্টোপাস।
ঝাপ দেয়ার পর তারা আমাকে অষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলতে পারে।
এনাকোন্ডার মতো নীরিহ দর্শন সাপ জলের নিচে আমাকে পেঁচিয়ে ফেলতে চাইবে
আমি গাঙশুশুকের মতো ভুস করে উঠতে চাইবো
একটু, এক পলকের শ্বাস নেয়ার জন্য।
তারা আমাকে টেনে ধরবে
আরো, আরো নিচে
অতল
খাদের পেটের ভেতর নিয়ে যেতে চাইবে।
জলের গভীর তলদেশ থেকে উঠে আসবে মানিক রাজার ডেকচি
তারা আমাকে সোনা, রুপা আর মোহরের গল্প শুনাবে
দেখাবে মৎসকন্যার লাস্যময়ী শরীর
লোভের লালচে ফেলে নিয়ে যাবে পাতালপুরি।
তারপর ভেড়া করে রেখে দেবে যাবজ্জীবন।

এইসব গা ছমছম ভয়ের গল্প।
প্রতিবার জলে ঝাপ দেয়ার আগে সে আমাকে শোনায়।
জলের নিচে কী আছে জানা নাই
তবু আলী আলী বদর বদর বলে জলে আমি ঝাপায়া পড়িবো।

ক্রসফায়ার

একটা আপনি আড়ালে গেলে আরেকটা আপনি সামনে এসে দাঁড়ায়
খাড়া হয়।
একটা তুমি উঁকিঝুকি পাড়ে।
কথা কয়। গান গায়। তারপর ঘুমিয়ে পড়ে।
আরেকটা আপনি সবুজ বাতি জ্বেলে বসে থাকে চুপচাপ।
যেন কথা বললেই হেরে যাবে। ডুবপলান্তি খেলা।
আরেকটা তুমি আসে বন্দুক নিয়ে। গুলি করে।
ক্রসফায়ার!
তারপর কান্না করে।
এইভাবে অনেকগুলো আপনি অনেকগুলো তুমি মিলে
সারারাত একটা আমির সঙ্গে খেলা করে। গান গায়। কান্না করে।
অনেকগুলো আপনি, তুমির সঙ্গে একটা আমি সারারাত খেলা করে
ভোরবেলা চুপচাপ ঘুমিয়ে থাকে। ক্রসফায়ারের লাশের সাথে।

বাচ্চাদের স্কুল

চাকরি চলে যাওয়ার পর
বউ একটা নতুন চাকরি ধরায়া দিছে
নোয়ামনিকে তার ইস্কুলে আনা-নেয়ার চাকরি।
এই চাকরিটা আমি অবশ্য আনন্দের সাথে করি।
বাচ্চাদের ইস্কুল আমার ভালো লাগে।
হরেক রকম বাচ্চা। একসাথে এত্তগুলা বাচ্চা। দৌড়ছে, কিচিরমিচির করছে
লুটোপুটি, হুটোপুটি। কী অদ্ভুত সুন্দর! বাচ্চাদের ইস্কুল ছাড়া
এই দৃশ্য আর কোথাও পাওয়া যাবে না।
একেকটা বাচ্চা ক্লাস শেষে বেরিয়ে এসে তার মায়েদের বুকে আছড়ে পড়ছে।
আমার দেখতে কী যে ভালো লাগছে!
আহা! বাচ্চাদের মায়েরা।
ফর্সা, গোলগাল। নাদুস নুদুস একেকটা বাচ্চার মা।
তারা আমাকে দেখে
আগুন্তুক ভাবে বোধহয়।
দেখে আর কী যেন ভাবে!
ভাবে কি? মনে হয় তারা আমাকে চোখ দিয়া খায়।
খাচ্ছে তো রোজ। অনেকজন।
আমারও ভালো লাগে। ভালো লাগলে আমিও খাই।
বাচ্চাদের ইস্কুল। এইভাবে অনেকজনের খাওয়া খাওয়ি হয়ে বেঁচে আছে দীর্ঘকাল।

কেউ আমাকে ফোন দিতে পারেন

কেউ আমাকে ফোন দিতে পারেন
চ্যাটক্লান্ত রমণীরা ঘুমিয়ে পড়েছে
গোপন প্রেমিকারাও তাদের স্বামী সন্তানের নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছে।
তাহাজ্জুদ পড়বেন বলে একজন আমাকে অপেক্ষা করতে বলে
নামাজে দাঁড়িয়ে গেছেন।
রাত ঘন হচ্ছে।
দীর্ঘ হচ্ছে।
আমি প্রচণ্ড গরমে ঘামছি।
ভাবছি, একটা শীতল পানীয়র মতো একটা ফোনকল যদি আসে।

যে কোনো বিষয় নিয়ে কথা হতে পারে।
আমি শুনবো।
যে কেউ আমাকে ফোন দিতে পারেন।
রাতের নিস্তব্ধতা খানখান করে দিয়ে বেজে উঠতে পারে রিংটোন।
ওপাশ থেকে ভারি বাজখাই গলায় কেউ কথা বলে ভেঙে দিতে পারেন
দীর্ঘকালের এই বধির বদ্বীপের নিস্তব্ধতা।
কেউ মোলায়েম গলায় শুনাতে পারেন নতুন কোনো গানের কলি।
কথা বলার যেকোনো বিষয়ই হতে পারে।
আমি শুনবো।
কেউ আগামিকালের গোপন কোনো অপারেশনের পরিকল্পনাও করতে পারেন।
আমি গোপনীয়তা বজায় রাখবো।

কেউ আমাকে ফোন দিতে পারেন।
বন্ধু অথবা শত্রু
শুনাতে পারেন প্রণয়, গোপন প্রেমের কোনো কাহিনি
অথবা কেউ বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করতে পারেন আগামিকালের মৃত্যু পরোয়ানা।
তবু কেউ ফোন করুক। এই দীর্ঘ রাতের নির্জনতা ছিঁড়ে
কথারা বলে উঠুক। খলবল করে বেরিয়ে পড়ুক নির্জন প্রকোষ্ঠ থেকে।
অনন্ত বোবা রাত্রির মুখে ভাষা ফুটে উঠুক।

কেউ আমাকে ফোন দিক।
জানি তো, তাদের স্বামী সন্তান রয়েছে। রয়েছে দিনের আলোর বিপুল সম্ভার।
আমি তাদের গোপনীয়তা বজায় রাখবো।