খাদিজাতুল কোবরার গদ্য ‘তেইশ বছর হলুদ পরিনি’

প্রকাশিত : মার্চ ০৮, ২০২০

আমি তখন অনেক ছোট। বয়স সাত কী আট বছর। একবার আমার সেজো মামা আমার ছোটবোন আর আমার বড় মামার মেয়ের জন্য দুটো ড্রেস কিনে আনে। একটা নেভি ব্লু আরেকটা মেটে রং। আমি চট করে মামার হাত থেকে নেভি ব্লুটা নিয়ে বললাম, এটা ইলাকে দাও। ওখানে মনে হয় আমার মা আর বড় মামিও ছিল। তখন মামা বললো, এটা সুমির জন্য। ওর গায়ের রঙে এটা ফুটবে। ইলা যেহেতু কালো তাই ওকে অন্যটা দিলো। ওই প্রথম আমি গায়ের রঙের সঙ্গে জামা কাপড়ের রং মিলিয়ে পরার যে একটা বিষয় আছে, তা জানি। এবং কালো-সাদারও। এই যে কালোরা এটা পরলে ভালো লাগে আর সাদাদের জন্য ওই রং, এই ধারণা নিয়ে আমার ২৩ বছর কেটে গেছে। এই ২৩ বছরে আমি কখনও হলুদ পরতে পারিনি। শুধুমাত্র কালোদের হলুদ মানায় না বলে এই চলতি ভাবনা থেকে। অথচ অনেক লোকজ উৎসবে সাঁওতালদের দলীয় নাচে হলুদ শাড়ি পরতে দেখতাম সব কুচ কালো নারীদের। অসাধারণ সেই দৃশ্য। আমার যে কী ভীষণ ভালো লাগতো। এখন আমি হলুদ পরি। মানে এখন আমার যা ভালো লাগে তাই পরি। কিন্তু কালো নিয়ে ওই ধারণা কিন্তু চেঞ্জ হয়নি। আমি দেখেছি, ধারণাগুলো সমাজ আমাদের মাথায় এমন করে গেঁথে দেয় যে, আপনি উল্টো ভাবনাটা সহজে করতে পারেন না। এখানে আপনার নিজেকেই ওই খোলস থেকে বেরুতে জানতে হয়।

রঙের উঁচুনিচু নিয়ে পরের গল্পটা আরো মজার। ২০১৫ থেকে ১৮, চার বছর আমি টেলিভিশনে খবর পড়ি। শুরুর দিকের কথা এটা। মেকাপ আর্টিস্টরা কিছুতেই বুঝতে পারেন না গায়ের রং। সব সবসময় তিন চার শেড সাদা করে আমার রং হালকা করে ফেলে। মানে কালো কম লাগে দেখতে। সে সময় কী ভয়াবহ অস্বস্তি নিয়ে যে খবর পড়তাম, বোঝাতে পারবো না। সবসময় যে তারাই সাদা করতে চাইতো তাও না, আমাদের মধ্যেই অনেকেই ছিল যারা নিজেরাই এটা হতে চাইতো। আমার খারাপ লাগতো এটা ভেবে যে, তাদের বদ্ধমূল ধারণা সাদা করলেই সুন্দর লেগে যায়। পরে অবশ্য স্টেশনের মেকাপ নিয়ে নতুন পলিসি, এর থেকে কিছুটা মুক্তি দিয়েছিল।

আমি জানি, সাদা-কালো বিবেচনায় ভালো-মন্দের হিসেব এ সমাজে আরও একশো বছর টিকে থাকবে। কিন্তু আমরা কি আসলে এই ভাবনার সঙ্গেই চলবো! আমার আত্মীয় বোনটার বিয়ে হচ্ছে না কালো বলে। বাড়ির নতুন কালো বউটিকে শুনতে হয় নানা কথা কিংবা যোগ্যতা থাকলেও কালো বলেই সুযোগ পায় না কত কিছুতে। এমন অসংখ্য বঞ্চনা আর অপমানের কথা বলা যায়। কিন্তু আমি বলতে চাই, এসব ভাবনা দূর করার ক্ষমতা আপনার নাই। কিন্তু আপনি নিজে কি ভাবছেন? রং নিয়ে এসব তিক্ততা দেশে দেশে বিভিন্ন রূপ ধরা দেয়। যদিও পুঁজি তার স্বার্থেই কাউন্টার ন্যারেটিভ কিছু এলিমেন্ট আমাদের সামনে নিয়ে আসে। যেমন বিউটি পেজেন্টটগুলোতে এখন কুচকুচে কালো মেয়েদেরও জয়ী করা হয়। হ্যাঁ, কিছুতো কাজ করাই হয় অনুপ্রেরণা কিংবা কালো নিয়ে আপনার বঞ্চনাকে কমাতে। কিন্তু আমি আসলে এই বিষয়টা নিয়ে ভাবতেই চাই না। কারণ আজকে আপনার চিন্তা বিয়ে পর্যন্ত কি সীমাবদ্ধ? না, আপনি যখন বিভিন্ন মাধ্যমে সারা বিশ্বের সঙ্গে নিজের যোগাযোগ স্থাপন করতে পারছেন এবং তুলনা করতে পারছেন আপনার অবস্থান কোথায়, সেখানে নিতান্তই একটা স্থানীয় ধারণা আপনাকে আটকে রাখে কিভাবে! আমাদের ভাবনার জগৎটা এখন এত বড় যে, গায়ের রং নিয়ে যত কিছু তা আসলে ওই জগতের চেয়ে খুব ছোট্ট একটা অংশ।

বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে আপনি হয়তো আমার সঙ্গে দ্বিমত করতে পারেন। কিন্তু আমরা যারা এই রং নিয়ে সচেতন তারা কেন আপসেট হয়ে যাই! আমার একজন সহকর্মী বন্ধু বলছিলেন যে, একজন রিকশাঅলারও কী নির্দ্বিধায় তার দুই মেয়ের দুরকম রং নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বা অবমাননাকর কথা বলছেন। এখন এই হেইট স্পিচগুলো আপনি কিভাবে বন্ধ করবেন, এটার কাউন্টার ন্যারেটিভ কি হবে? নিশ্চই কালোকে ভালো বলে নয়, কালো স্বর্গীয় বা কালো আরও উন্নত, কালো আলাদা এগুলো বলে কি লাভ! আমার মনে হয় তথ্য ও জ্ঞানভিত্তিক একটা বিশ্বে লড়াই করার হাতিয়ারগুলো আরও ধারালো হওয়া উচিত।

আপনি বড় পরিসরে পড়ছেন, খেলছেন  বা গবেষণা করছেন। সেখানে গায়ের রং খুব তুচ্ছ লাগে না আপনার কাছে? ব্যক্তি মানুষকেই আসলে নিজের লড়াইটা করতে হবে। আমি নিজেই যখন ধরে নিচ্ছি কালো খারাপ তখন কালোকে গ্লোরিফাইমূলক কথাগুলো ভালো লাগলেও এটাও এক ধরণের সান্ত্বনা, নয় কি?

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী