চাঁদ সোহাগীর ডায়েরী

পর্ব ৩৫

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ১৫, ২০১৯

মল ত্যাগের জন্য জানোয়ার যেমন নরম মাটি খোঁজে, তেমন কিছু মানুষ আরো কিছু মানুষকে খোঁজে বিষ নিষ্ক্রমণের জন্য, যাকে টেনে হিঁচড়ে নগ্ন করে অপমান করে আঘাত দিয়ে প্রয়োজনে খুন করে নিজের বিষ তার ভেতর পুরে দিয়ে নির্বিষ হওয়া যাবে, উদযাপন করা যাবে নিজের দীনহীন অস্তিত্বের উল্লাস। এখন প্রশ্ন হলো, আপনি পাগল কুকুরের হাত থেকে বাঁচতে জলাতঙ্কের টিকা লাগানোর কথা ভাববেন, না সেই সমস্ত কুকুরদের ধরে নির্বিষকরণের কথা! প্রথমটি কেবল আপনার ওপর নির্ভর করে। দ্বিতীয়টি দীর্ঘমেয়াদি।

একবার কলকাতার এক প্রখ্যাত কলেজের অধ্যাপক আমাকে বলেছিলেন, বাজারে চাকরি বাকরির এত মন্দা কেন জানো? তোমরা মেয়েরা। তোমরা এসে ছেলেদের কাজে ভাগ বসাচ্ছো!

মহিলাদের প্রতি এত `সম্মান` যার, মনে রাখা প্রয়োজন তিনি কিন্তু কোনও অশিক্ষিত মানুষ ছিলেন না, ছিলেন এক বিখ্যাত কলেজের অধ্যাপক! এহেন মানুষ মূল্যবান নোটের বিনিময়ে, যা পেলে নাকি ফার্স্ট ক্লাস নম্বর বাঁধা, কন্যাসমা ছাত্রীদের গাত্রস্পর্শ চাইতেন। মেয়েরা যে মানুষ নয়, এই অশিক্ষার চিরন্তন প্রবাহ চলে পরিবারতন্ত্রের ধমনীর ভেতর। এবং এই কুশিক্ষার প্রবহমানতায় সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় মহিলারাই। নিজের জীবনে অসাম্যের শিকার হয়েছে যে মহিলারা তারাই নারী-পুরুষের অসমতাকে প্রমোশন দেয়।

মেয়ে যতই শিক্ষিত বা স্বনির্ভর হোক না কেন, অনেক মায়েরা এখনও বিশ্বাস করে স্বামীসুখই শেষ কথা, মেয়ে তো লতানে গাছমাত্র! ছেলে যদি বউকে মানুষের মতো ট্রিট করে, অনেক ছেলের মায়েদেরই তাতে নাভিশ্বাস ওঠে আজও। মুখে যতই নারীবাদের বুলি কপচাকনা কেন, এমন অনেক মহিলাদের জানি, যারা নির্দ্বিধায় নিজেদের শরীরটি মেলে দিয়েছে কেবল পদোন্নতি পাবে বলে বা কোনও বিশেষ ক্ষেত্রে পুরস্কৃত হবে বলে। যে পুরস্কার দানের বরাত ছিল এতদিন কেবল পুরুষের কুক্ষীগত, সেই চিরন্তন ও একচ্ছত্র মহিমা ছাড়তে তাদের একটুও লাগবে না বুঝি?

কিছু কিছু পুরুষের কাছে তাই মহিলারা হলো গিয়ে নরম মাটি, যা ইচ্ছেমতো কুপিয়ে শরীর ও মনের সমস্ত বিষ ঢেলে দিয়ে হালকা হওয়া যায়। তা হতে পারে বউ পিটিয়ে, কিংবা কোনও মহিলার শ্লীলতাহানি করে, বা এমন কিছু করে যাতে কোনও মহিলা অস্বস্তি বা অপমানের শিকার হয়, অথবা তাকে আঘাত দিয়ে, সর্বোপরি তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে তথা ধর্ষণ করে যার মধ্যে দিয়ে সোকল্ড নর্ম অনুযায়ী একজন মহিলার সর্বোচ্চ সামাজিক ক্ষতি করা যায়। তাতেও শান্তি না হলে জ্বালিয়ে তো দিতেই হয় লাশ!

নাগরিক সভ্যতার পত্তন হয়েছে যতদিন পৃথিবীর বেশিরভাগ সম্পদ ওদেরই কুক্ষীগত থেকেছে, কারণ ওদের পেশীশক্তি সম্পদ আহরণের সহায়ক হয়েছে। আর এই সুতীব্র লড়াইয়ে ওদের যাবতীয় ক্লান্তি ধুয়ে মুছে দেয়ার কাজ করেছে মেয়েরা, বাড়িয়ে দিয়েছে সেবার হাত। সেই লুটেরার দল একটা জিনিস বড় স্পষ্ট করে বুঝে নিয়েছে, তা হলো `সম্পদের অধিকার`। যা কিছু সম্পদ তার একার কুক্ষীগত হয়েছে তার মধ্যে কেবল জমিজমা টাকা পয়সা ধন দৌলত নয়, আছে `নারী`সম্পদও। এখন কিনা সেও যাবতীয় আব্রু ছেড়ে বেরিয়ে এসে বাজারে দাঁড়িয়ে সম্পদের লড়াই লড়বে পুরুষের সাথে এ মেনে নিতে কষ্ট হয় অনেক পুরুষেরই।

ধর্ষণ শুধু রাস্তাঘাটে অন্ধকার গলিতে হয় না। ধর্ষণ হয় ঘরে ঘরে, নারীকে কুক্ষীগত করার স্বার্থে, এ হলো চূড়ান্ত প্রতিশোধ। যতই নারী স্বাধীনতার কথা বলুন, যতই ছুরি কাঁচি স্প্রে বোতল নিয়ে রাস্তায় নামার কথা ভাবুন, যতই পথঘাট চিনে রাখুন সাথে রাখুন ইমার্জেন্সি নম্বর, আপনারা তারাই যারা এখনো ধর্ষণের শিকার হননি বা হলেও চুপচাপ হজম করে নিয়েছেন। শুনশান হাইওয়েতে স্কুটার খারাপ হলে চারদিক থেকে যদি ধেয়ে আসে ওৎ পেতে থাকা চার শিকারি তবে এই সব বিনামূল্যে বিতরণ করা জ্ঞান খুব কমই কাজে আসবে। তার চেয়ে ভালো ও পথ বর্জন করা।

বরং ভাবুন প্রকৃতি থেকে নিজেকে টেনে হিচড়ে নিয়ে আসা এই যে নাগরিক সভ্যতার বিষ তাকে কিভাবে নিউট্রালাইজ করা যায়। সভ্যতা বলে আমরা যাকে ধারণ করছি, এতদিন সে হলো আদ্যন্ত প্রকৃতি বিরোধী এক যাপন। আর এর উপজাত যে বিষ তাকে এই জীবন থেকে নিষ্কাশন করার সত্যিই কোনও উপায় নেই বোধহয়, কারণ এভরি কয়েন হ্যাজ ট্যু সাইডজ। তাই যতদিন সভ্যতার অস্তিত্ব থাকবে ততদিনই থাকবে অপরাধপ্রবণতা।

সম্ভব হলে ধর্ষণ নিয়ে আলোচনা কম করুন। কারণ, আমার ধারণা অপরাধ নিয়ে বেশি আলোচনা করলে অপরাধকেই প্রমোট করা হয়। চলবে

লেখক: কবি