চাঁদ সোহাগীর ডায়েরী

পর্ব ৩৬

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ১৮, ২০১৯

আমাদের ভারতবর্ষের যে আইন ব্যবস্থা তা ক্যাপিটাল পানিশমেন্টের বিরুদ্ধে। এখানে অপরাধীকে দণ্ডদান করার অর্থ, তাকে খুন করে ফেলা নয়, তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়া তথা আত্মসংশোধনের একটি সুযোগ ও প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাওয়া। ক্রিমিনাল জুরিসপ্রুডেন্স এটাই বলে যে, অপরাধ কোনও ব্যক্তির সাথে হয় না। যখনই কোনও অপরাধ হয় তা হয় সমাজের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। কারণ প্রতিটি রাষ্ট্রবাসীর জীবনের সুরক্ষা তার গণতান্ত্রিক অধিকার।

এর প্রাসঙ্গিকতা এখানেই যে, রাষ্ট্র যদি প্রতিটি মানুষকে অন্ন বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা চিকিৎসা তথা তার নূন্যতম অধিকারগুলির নিশ্চয়তা না দিতে পারে, তবে সেই অধঃপতিত অবস্থার সাপেক্ষে কোনও ব্যক্তি যদি কোনও অপরাধ করে বসে তবে সরাসরি তার গলায় ফাঁসির দড়ি পরিয়ে দেয়ার কোনও অধিকার রাষ্ট্রেরও নেই। ভারতবর্ষের আইনের এই মহানুভবতার সুযোগ নিয়ে অবশ্য নিষ্কৃতি পেয়ে যায় অনেক ক্ষমা-অযোগ্য আসামিই।

কোনও একটি নেতিবাচক কাজ তখনই অপরাধ বলে পরিগণিত হয়, যখন সেই কাজের পিছনে `মেনস রিয়া` বা অপরাধী মনস্তত্ত্ব কাজ করে। মেনস রিয়া থাকে না বলেই পাশের বাড়ির বেড়াল চুপিচুপি অন্যের রান্নাঘরের খাবার চুরি করে খেয়ে গেলেও কেউ তাকে `চোর` প্রতিপন্ন করতে পারে না। কারণ বিড়ালটি জানেই না যে, সে তার অধিকারের বাইরে গিয়ে কিছু করছে। একজন মানসিক ভারসাম্যহীন মহিলা কাউকে পাথর ছুঁড়ে মারলেও গ্রিভিয়াস হার্ট প্রুফ হবে না। কারণ সে জানে না, কোন কাজের কি কনসেকোয়েন্স।

জুভেনাইল ল’গুলিও রয়েছে এই কারণেই। ঠিক যেমন একটি দশ বছরের বালকের করা কোনও চুক্তি কনট্র্যাক্ট বলে গণ্য হবে না, বারো বছরের বিয়ে বৈধ বলে গণ্য হবে না, তেমনি এগারো বছরের একটি ছেলে অপরাধ করলেও সে আইনের সুরক্ষা পাবে। কারণ তার মনটি একটি পরিপূর্ণ অপরাধী মন হয়ে ওঠার থেকে বাঁচিয়ে নেয়ার জন্য রয়েছে অনেক সময়। ভারতবর্ষের ক্রিমিনাল  ল‘ অপরাধীকে ঘৃণা করে না, করে অপরাধকে। এই মহান আদর্শকে সামনে রেখে এগোলেও সবসময় যে ন্যায় বিচার হয়, এমনটা নয়। ফলত যা প্রকট হয়ে ওঠে তা হলো, রাষ্ট্র ও ব্যক্তি মানুষের দ্বন্দ্ব। বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কেঁদে মরে।

একথা মনে রাখা প্রয়োজন, যতই আমরা নিজেদের সভ্য বলে দাবি করি না কেন, সভ্যতা আসলে একটা কনসেপ্ট অথবা একটা নিরবিচ্ছিন্ন পদ্ধতি কোনও একটি কাল্পনিক মানবিক অবস্থায় পৌঁছানোর জন্য। জন্তুদের মধ্যে কোনও `মেনস রিয়া` নেই। কারণ তথাকথিত সভ্য হয়ে ওঠার জন্য ওদের কোনও জার্নিও নেই। ওরা প্রকৃতির সাথে একাত্ম, ওদের কোনও হতাশা নেই। হতাশা আছে মানুষের। কারণ সে সারাক্ষণ কোথাও না কোথাও একটা পৌঁছানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। সে অসুখি, তাই কেবল বাহ্যিকভাবে কিছু পরিস্থিতি তৈরি করার চেষ্টা করে যাচ্ছে, যাতে সে সুখী হতে পারে।

মানুস মৃত্যু চেতনায় আক্রান্ত, তাই সর্বদা জীবনকে অতিক্রম করার চেষ্টা করে চলেছে। সে `ইনসিকিওর` তাই কিছু না কিছু আহরণের চেষ্টা তার রিপুগত। এই চূড়ান্ত বিষাদ তার অপরাধী মনস্তত্ত্বের কারণ, যা তার আদিম মানব থেকে আধুনিক মানুষ হয়ে ওঠার পথে তার অস্তিত্বের সাথে নিগূঢ় ভাবে মিশে গেছে। জন্তুও তাই এত বর্বর নয়, যতটা হতে পারে মানুষ সেই বিষাদের উত্তরাধিকারে। যে বিষাদ বুকে নিয়ে একদিন সে জঙ্গল কেটে সাফ করেছে, সে বিষাদই তাকে স্বজাতির বিরুদ্ধে প্ররোচিত করবে, এই তো ছিল ভবিতব্য।

যে মানুষ কোথাও পৌঁছতে চেয়েছিল, সুদীর্ঘ পথের ক্লান্তি বুকে নিয়ে সে একদিন বুঝতে পারবে, আসলে কোথাওই পৌঁছানোর ছিল না। সেদিন সে শান্ত হবে। তার বিক্ষত অস্তিত্বের রুদ্ধশ্বাস চেতনা একদিন তাকে জানান দেবে:

অর্থ নয় কীর্তি নয় স্বচ্ছলতা নয়
আরো এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতর খেলা করে
আমাদের ক্লান্ত করে
ক্লান্ত ক্লান্ত করে...

তারপর `রক্ত ক্লেদ বসা থেকে রৌদ্রে ফের উড়ে যায় মাছি`...

জানি না এত অগম্য পথ পার করে আসা মানুষ সেদিন এমন কোনও অপার রৌদ্রের সন্ধান পাবে কিনা। নাকি সকলে সমোচ্চারে বলে উঠবে, দাও ফিরে সে অরণ্য, লহো এ নগর! চলবে

লেখক: কবি