সস্ত্রীক নরেন্দ্রনাথ মিত্র

সস্ত্রীক নরেন্দ্রনাথ মিত্র

নরেন্দ্রনাথ মিত্রের আত্মস্মৃতি ‘গল্প লেখার গল্প’

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১৯

কথাসাহিত্যিক নরেন্দ্রনাথ মিত্রের আজ ৪৪তম প্রয়াণদিবস। তিনি ১৯৭৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর মারা যান। ১৯১৭ সালের ৩০ জানুয়ারি ফরিদপুরের সদরদিতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে তার আত্মস্মৃতি পুনর্মুদ্রণ করা হলো:

ছোট-বড় মাঝারি ভালো-মন্দ মাঝারি জীবনে কত গল্পই না লিখলাম। তবু অলিখিত গল্পের সংখ্যা যেন আরো বেশি। যে সব গল্প লিখব বলে ভেবে রেখেছি অথচ শেষ পর্যন্ত লেখা আর হয়ে ওঠেনি, যে সব গল্পেব ইশারা সামান্য একটু সাড়া দিয়েই চঞ্চল পায়ে অদৃশ্য হয়ে উঠেছে, যারা কেবল চকিতের জন্যে দেখা দিয়েছে অথচ ধরা-ছোঁওয়া দেয়নি, তাদের সংখ্যা কম নয়।

লেখা গল্পগুলির কথা থাক। না লেখা গল্পগুলির কথাই বলি। পিছনে ফেলে আসা দিনগুলির আর দিন ভরে রাত ভরে লেখা গল্পগুলির দিকে তাকিয়ে কেমন যেন একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে। বাস্তব আর কল্পিত, অরচিত আর স্বরচিত সব মিলিয়ে এই গল্পগুলি যেন আমারই জীবনবৃত্ত। অনেকদিন আগে নারকেলডাঙ্গায় একটি ভাড়াটে বাড়িতে আমি সপরিবারে বাস করতাম। দোতলায় বাড়িওয়ালা থাকতেন আর একতলায় থাকতাম আমরা তিন ঘর ভাড়াটে।

সেই বাসা ছেড়ে দেবার প্রায় বিশ বছর বাদে কোনো একটা উপলক্ষে আবার আমাকে ওই অঞ্চলে একদিন যেতে হয়েছিল। কি কৌতূহল হলো, ঘুরতে ঘুরতে গিয়ে দাঁড়ালাম সেই বাসাবাড়িটার সামনে। দেখি, আমাদের সেই ঘর দুখানি জুড়ে আর একটি নবীন দম্পতি বসবাস করছে। আমার সেই পুরনো ঘরের নতুন বাসিন্দারা আমাকে খুবই আপ্যায়ন করল। চা এলো, মিষ্টি এলো। এলো সানুরাগ অনুরোধ, আবার আসবেন, কবে আসবেন বলুন।

বিদায় নেয়ার সময় আব একবার আমি সেই ঘর দুখানির দিকে তাকালাম। কেমন যেন একটা উদাস বৈরাগ্যে মন ভরে উঠল। এই ঘর একদিন আমার ছিল, আজ আর আমার নয়। পুরো তিন বছর আমি এই ঘরে কাটিয়ে গেছি। তিনশো পঁয়ষট্টিকে তিনগুণ কবলে কত হয়? বৃহৎ পারিবাবিক বন্ধনের মধ্যে ছোট ছোট সুখ-দুঃখে আন্দোলিত হতে হতে এখানে সহস্র দিন-রজনী আমি বাস করেছি। এই বাসা যেমন এখন আর আমার নয়, সেই দিনরাত্রিগুলিও তেমনি আর পুরোপুরি আমার নয়। প্রত্যক্ষ হারিয়ে তারা অতীতের ছায়ার মধ্যে মুখ লুকিয়েছে।

আপনারা বিশ্বাস করবেন কিনা জানিনে, নিজের পুরনো গল্পগুলির দিকে তাকালেও আমার প্রায় ওই ধরণের একটা অনুভূতি হয়। এগুলি যেন আমার অতীতের লীলাক্ষেত্র। বহু গল্পের কথাই আমার আর মনে নেই। পাত্রপাত্রীর নাম মনে রাখা সম্ভব নয় কিন্তু বহু গল্পের ঘটনাসংস্থানের কথা, তাদেব শুরু আর শেষের কথাও আমি বিস্মৃত হয়েছি। একবার এক কাণ্ড ঘটেছিল। এক ভদ্রলোক আমার একটি গল্প পড়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। গল্পটি আমার আগের লেখা কিন্তু তিনি পড়েছেন সদ্য সদ্য। তিনি পাত্রপাত্রীর নাম উল্লেখ করে ঘটনাবিন্যাসের কথা বলে, জায়গায় জায়গায় লাইন পর্যন্ত মুখস্থ বলে পরম উল্লাসে উৎসাহে আমার সঙ্গে আলোচনা শুরু করলেন। একজন লেখকের কাছে এসেছেন একজন সাহিত্যরসিক পাঠক। আমি মস্ত বড় অরসিক বনে গেলাম গল্পটিব কথা আমি একেবারেই ভুলে গেছি। আমি তার সঙ্গে তাল রেখে একবার বলি, হুঁ, আর একবার বলি, হাঁ। আর একবার বলি, না। তা কি হয়!

গোঁজামিলটা তার চোখে ধরা পড়ে গেল। তিনি হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কিছু মনে করবেন না। গল্পটা কি সত্যি আপনিই লিখেছিলেন?’ বললাম, ‘একদা লিখেছিলাম। কিন্তু আজ যে আমি অন্য গল্প লিখছি। লিখতে লিখতে উঠে এসেছি আপনার কাছে।’

লেখকের গল্পগুলির উৎস নিয়ে হয়তো আপনাদের কারো কারো মনে কৌতূহল আছে। আমার নিজের তেমন খুব একটা কৌতূহল নেই। গল্পের নেপথ্যে যে গল্প থাকে তা না শোনাই ভালো। আমার মনে হয়, তাতে আসল গল্পের রসহানি ঘটে। আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা থেকেই লিখি। কিন্তু সেই অভিজ্ঞতাব আনাগোনা কখনো রাজপথে, কখনো সুড়ঙ্গপথে। কখনো সেই পথরেখা চোখে দেখা যায়, কখনো তা দৃষ্টিগোচর হয় না। এই অগোচরতাই লেখকের নিজের পক্ষে বিস্ময়কর! এতেই তার সৃষ্টির আনন্দ।

দুটি একটি গল্পের কথা বলি। ধরা যাক ‘রস’ গল্প। এ গল্পের যে পটভূমি তা আমার খুবই পরিচিত। পূর্ববঙ্গে আমাদের গ্রামের বাড়িতে পূব দিকে ছিল একটি পুকুর। সেই পুকুরের চারধারে ছিল অজস্র খেজুর গাছ। ছেলেবেলা থেকে দেখতাম, আমাদের প্রতিবেশী কিষাণকে সেই সব খেজুর গাছের মাথা চেঁছে মাটির হাঁড়ি বেঁধে রাখতে। বাঁশের নল বেয়ে সেই হাঁড়িতে সারারাত ধরে ঝিরঝির করে রস পড়ত। সেই রস কড়াইতে কবে, বড় বড় মাটির হাঁড়িতে কবে জ্বালিয়ে গুড় তৈরি করতেন আমাদের মা-জ্যেঠীমারা। শীতের দিনে রস থেকে গুড় তৈরি এই প্রক্রিয়া মায়ের পিঠের কাছে দাঁড়িয়ে থেকে রোজ দেখতাম। আমার চিরচেনা এই পরিবেশ থেকে রস গল্পটি বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু রসের যে কাহিনী অংশ, মোতালেফ  মাজু খাতুন আর ফুলবানুকে নিয়ে যে হৃদয় দ্বন্দ্ব, খেজুর রসকে ঘিরে রূপাসক্তির সঙ্গে যে জীবিকার সংঘাত তা কোন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে আসেনি। সেই কাহিনী আমি দেখিওনি, শুনিওনি। তা মনের মধ্যে যেন আপনা থেকেই বানিয়ে বানিয়ে উঠেছে।

আর একটি গল্পের কথা মনে পড়ে ‘সেতার’। এই গল্পে যক্ষ্ম রোগগ্রস্ত স্বামীকে সুস্থ করবার জন্যে স্ত্রী সেতারের টিউশনি করত। সামান্য যা কিছু আয় হতো তা যেত স্বামীর সেবায়। প্রয়োজনের জন্যে যে সঙ্গীত চর্চা বউটি শুরু কবেছিল ধীরে ধীরে সেই চর্চায় সে আনন্দ পেতে লাগল। ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে তার পরিচিতি বাড়ল, খ্যাতিও হল। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে স্বামী যেদিন বাড়িতে এলো, স্ত্রীর সেইদিনই ডাক পড়ল একটি বড় অনুষ্ঠানে বাজাবাব জন্যে। এমন সম্মান সে এর আগে কোনোদিন আর পায়নি। কিন্তু স্বামী তাকে ছেড়ে দিতে চায় না। এতদিন পরে স্ত্রীকে সে কাছে পেয়েছে। কত রোগ যন্ত্রণা মৃত্যুভয় পার হয়ে সে এসে পৌঁছেছে তার স্ত্রীর কাছে। এত দীর্ঘদিনের বিরহের পর স্ত্রীর সঙ্গে তিলমাত্র বিচ্ছেদ যেন তার সহনাতীত। সঙ্গীতেব আসরে স্ত্রীর আর যাওয়া হলো না। কিন্তু তার এই থাকাটাই কি পুরোপুরি থাকা?

এই গল্প এলো কোত্থেকে ? হাসপাতালে কি হাসপাতালের বাইরে আত্মীয় অনাত্মীয় বহু যক্ষ্মা রোগীকেই তো দেখেছি। গীতানুরাগিণী একটি গৃহবধূর সঙ্গেও আমার পরিচয় ঘনিষ্ঠ। কিন্তু এই আখ্যানটির দুটি প্রধান চরিত্র, তার কাহিনী অংশ, আর কাহিনীসঞ্জাত যে হৃদয়বেদনা, তা আগে আমি দেখিওনি শুনিওনি। মনের কোন আক্ষেপ কোন ভাবাবেগ থেকে এই গল্পের সৃষ্টি হয়েছিল আজ আমার পক্ষে তা বলা কঠিন। এই অক্ষমতাটুকু শিল্পীর অগৌরবের নয়। বরং এই অনির্বচনীয়তায় তার আনন্দ। লেখার মধ্যে সে সবই ব্যক্ত করতে চায় না, বোধ হয় পারেও না। সবই যদি ভাষায় বলে দেব তবে আভাস আর ইশারা আছে কিসের জন্যে?

সব লেখকই নিজের চেনাজানা গণ্ডি ভিতর থেকে গল্পের উপাদান পেয়ে যান। আমিও তাদের ব্যতিক্রম নই। তবে কেউ কেউ বলেন আমার লেখায় সামান্য ছদ্মনামের আড়াল যদি বা থাকে, ছদ্মবেশের আড়ালটুকু থাকে না। যাদের নিয়ে লেখা তারা নিজেদের চিনে ফেলে। পাঠকদের মধ্যে যদি তাদের আত্মীয় কেউ থাকে তারাও জেনে যায়। এই দুর্বুদ্ধির জন্যে শাস্তি পেতে হয়েছে। আইন আদালতের শাস্তি নয়, সামাজিক শাস্তি। এই নিয়ে একজন বান্ধবীর সঙ্গে চিরবিচ্ছেদ হয়ে গেছে। সেই দুঃখের কথা আজ মনে পড়ে। অথচ আমি আমার সেই গল্পটির মধ্যে তাকে ছোট করিনি, অপমানও করিনি। হৃদয়ে পরিপূর্ণ সমবেদনা আর সহানুভূতি দিয়েই আমি সেই প্রেমের গল্পটি লিখেছিলাম। পরিণাম হলো অপ্রেম।

কেউ কেউ আবার অন্যরকম অনুরোধও করেছে, ‘লিখুন আমাকে নিয়ে। আমি যেন আপনার লেখার মধ্যে থাকি।’ লিখতে বসেছি সেই অনুরোধকারিনীকে নিয়ে। কিন্তু লিখতে লিখতে সেই একজনের সঙ্গে আরো কতজন যে মিশে গেছে , সেই বাস্তবিকার সঙ্গে লেখকের একটি মানসবাসিনী কেমন করে যে অঙ্গাঙ্গী হয়ে রযেছে তার রাসায়নিক বিশ্লেষণ কে করবে? মেয়েটি আমার সেই গল্প পড়ে মুখ ভার কবে বলেছিল, ‘এ কার মূর্তি এঁকেছেন? এ তো আমি নই।’ আমি তার মুখের সঙ্গে আমার নায়িকার মুখ মেলাতে মেলাতে জবাব দিয়েছি, ‘এও তুমি।’

আর একটি মেয়ের কথা বলি। সে আমাকে একেবারে হাতে নাতে ধরে ফেলেছিল। অপূর্ব ভঙ্গি করে বলেছিল, ‘আপনার সঙ্গে বেশি মিশব না। আপনি যে এত মেলামেশা করেন তার বিশেষ একটা উদ্দেশ্য আছে।’ মেয়েটির জীবনে কিছু প্রণয়ঘটিত জটিলতা ছিল। আমি তা জানতাম। তার কথার জবাবে আমি অবাক হয়ে বলেছিলাম, ‘উদ্দেশ্য? আমার তো ধারণা আমি একেবারে নিষ্কাম।’ সে বলেছিল, ‘নিষ্কাম না হাতি। আপনি আসেন গল্প লেখার তাগিদে।’ আমি তাকে বলেছিলাম, ‘অমন কথা বোলো না। আমি আসার তাগিদেই আসি। তুমি তো জানো না, লেখকরা যাদের ভালোবাসে তাদের নিয়ে লিখতেও ভালোবাসে। লেখাটা তাদের ভালোবাসারই অঙ্গ।’ মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গে আমার কথা মেনে নেয়নি। তর্ক জুড়ে দিয়েছিল, ‘অমন বড়াই করবেন না। আপনার বেশির ভাগ গল্পই প্রেমের গল্প তা জানি। তবু গল্পে উপন্যাসে আপনি যত মেয়ে-পুরুষকে এনেছেন, যত চরিত্রে সৃষ্টি করেছেন, তারা সবই কি আপনার ভালোবাসার জন্য?’

চট করে জবাব দিতে পারিনি। কিছুক্ষণ আমাকে নির্বাক থাকতে হয়েছিল। ভেবেছিলাম কথাটা হয়তো অসত্য নয়। সবাইকে সমান ভালোবাসতে পারিনি। আমাব সৃষ্ট চরিত্রগুলির সকলের প্রতি সমান মনোযোগ দেয়া হয়ে ওঠেনি। হয়তো ইচ্ছা ছিল না, হয়তো সে সাধ্যও ছিল না। কিন্তু পিছন ফিরে তাকিয়ে বই না পড়ে নিজেব গল্পগুলিব কথা যতদূর মনে পড়ে আমি দেখতে পাই ঘৃণা বিদ্বেষ বাঙ্গ বিদ্রুপ বৈরিতা আমাকে লেখায় প্রবৃত্ত করেনি। ববং বিপবীত দিকের প্রীতি প্রেম সৌহৃদ্য, স্নেহ শ্রদ্ধা ভালোবাসা পারিবারিক গণ্ডির ভিতরে ও বাইরে মানুষের সঙ্গে মানুষের বিচিত্র সম্পর্ক, একের সঙ্গে অন্যের মিলিত হবার দুর্বার আকাঙ্ক্ষা বারবার আমার গল্পের বিষয় হয়ে উঠেছে। তাতে পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। তা জেনেও আমি আমার সীমার বাইরে যেতে পারিনি। অথচ জানি, সংসারে অনাচার অবিচার আর অত্যাচারের অভাব নেই। প্রেমের শক্তি যেমন শক্তি, প্রয়োজনবোধে ঘৃণা বিদ্বেষের শক্তিও তেমনি। বৃহত্তর প্রেম গভীবতর কল্যাণকে অবারিত কবার জন্যে সেই শক্তিরও প্রয়োজন আছে। শুধু আলিঙ্গন নয়, দরকার হলে আঘাত করতেও জানা চাই, আঘাত করতেও পারা চাই। সেই পৌরুষ সেই বীর্যবত্তা মানুষের জীবনকে সমৃদ্ধ করে, লেখকের রচনার মধ্যে দীপ্তি এনে দেয়।

কিন্তু এই তত্ত্ব আমি জ্ঞান দিয়ে জানি, বুদ্ধি দিয়ে জানি। একে হৃদয়েরসে জারিত করে রসরূপ দিতে জানিনে। নিজের স্বভাবকে দেখে নিয়ে, নিজের প্রবৃত্তি আর প্রবণতাকে স্বীকার করে আমি সারা জীবন শুধু ভালোবাসার গল্পই লিখেছি। সে ভালোবাসা হয়তো সঙ্কীর্ণ অর্থে ভালোবাসা, সীমিত অর্থে ভালোবাসা। তবু তা ভালোবাসা ছাড়া আর কিছু নয়।

বৈশাখ ১৩৮১