পাপিয়া জেরীনের দীর্ঘকবিতা ‘দেজা ভ্যু’

প্রকাশিত : এপ্রিল ১৯, ২০১৯

নিকটতম নক্ষত্র নিয়ে পতনের পর
পুরোনো গ্রহের মতো খুঁজে চলেছি
এক গভীর গুহার ক্ষত
দেখেছি, অন্ধকার গিলে বসে আছে
হিমালয়ান রক সল্ট ল্যাম্প
জর্ডান থেকে সিন্ধুতে জ্বলে আছে
শুধু গোলাপি আলোর শীত;

দেখেছি পেরুর পাথরে পাথরে
গ্যালাকটিক রোদ
নাজাকা লাইনস,
ঈগলের উত্তল চোখ থেকে
মুছে যাওয়া আকাশের ম্যাপ—
যেখানে নতুন মেঘের ভেতর
হারায়েছে পুরোনো পথের দাগ

আরো দেখা হয়ে আছে
অবিস্মৃত এক কোষের মশালে
জ্বলে ওঠা প্রাচীর... পেত্রোগ্রাফ,
পাথরের বুকে নিভে থাকা তাপ
আর নদীর আগুন
দেখেছি কোকোয়ার খনির লবণ,
মৌয়ালের কালো হাতে
জমে থাকা মোমের খাঁজ,
পরাভূত— মায়া-আজটেক
আর সভ্যতার পতন;
আছে মিশরের জরায়ুজ ঘোরে
অলীক ঘুমের মতো পিরামিড
পবিত্র প্যপিরাস, চিত্র-বর্ণ-অক্ষরে
এক ডেমোটিক স্ক্রিপ্ট—
আর সমাধির দেয়ালের সুরে
বীণাবাদকের গান!

শুনেছি নৈঃশব্দ্যের দিন ঝরে আছে
পানামের পথে বকুলের মতো,
সেইখানে কিঙ্কিণী নেচেছিল
আম্রপালিরাতে বুকের ভেতর;
তখনও টেরাকোটার শরীরে
পুষ্পশর, আর জমে থাকা
চিনিগুড়া পুতুলে
ভরে আছে খাজুরাহো—
সেইখানে পরম প্রার্থিত মুদ্রায়
ফুটে থাকে আদিম অর্কিড,
আরো আরো ফুটে মিয়োসিসে
বিন্যস্ত জেনোম, লীন সংকেতে

এইসব দৃশ্যের স্তব্ধতা নিয়ে
এইখানে এসেছিল ধূসর রেসার
দেখেছি, সে আমারি মতো ঘুরে ঘুরে
শস্যের ক্ষেতে, পাথরের পিঠে দেখে
কোষময় দ্বীপ— পুঞ্জ নীহারিকা,
অণুর অক্ষের ভেতর সূর্যপথ,
পিউপিলে ডুবে থাকা গ্যালাক্সি,
পাতায় সূক্ষ্মতম নদীর শিরা,
প্যাপিলিওনিসির প্রতীকী বুকে—
কৃষ্ণচূড়ার দিন;
জেনেছি... সমুদ্রের ঢেউ ঘেঁষে
হেঁটে যাওয়া লাল কাকড়ার
ফিবোনাক্কি ছাপ, গোল্ডেন রেশিও
মেনে চলা নিয়ম বিন্যাস
আর `পাই` এর মানের মতো
পুনরাবৃত্ত এই জীবনের নাম

এই গ্রহের ভেতর যা আছে
দৃশ্যত ও জ্ঞাত সব—
হলো প্রাচীন হৃদয় ছাপ,
শ্যাওলায় জমে থাকা এমারেল্ড
যেমন হারায় দ্যুতি... তেমনি
বিস্মৃতির অতলে ডুবে ছিল সব;
এইসব পায়ে হাঁটা পথে
মুখোমুখি যত মুখ
আমারি মতন তাকায়ে আছে
আমার মুখের ভেতর!
মনে হতে থাকে একা আমি
ছড়ায়ে গেছি দর্পচূর্ণ,
অ্যামিবার মতো দ্বিখণ্ডিত—
অনুলিপি পরস্পর
হয়েছি সহস্র থেকে সহস্রাধিক!

তারপর একদিন,
এই পেত্রার পথ ধরে—
কিংবা ইলোরায় নরম আলোয়
আগুনে পুড়েছিল সমস্ত আকাশ,
শূন্যের মতো ছেয়ে থাকা অকারণ মেঘ
আর ধূলিকণা ঠেলে
আলোর দূরত্ব ভুলে এসেছিল কেউ—
প্রেমের সর্বনাম;

ডুবুরির মতো পল্লব কেটে
নিয়েছিল ব্যথার ঝিনুক,
সন্ধ্যার মতো চুলে রেখে হাত
আরো বলেছিল—
এই সব ছায়াপথে জেগে আছে
শুধু আমাদেরই প্রাণ

সেই প্রেমের ভেতরে
ডুব দিয়ে একদিন—
ভেদে-অভেদে সংখ্যায়
বেড়ে যেতে থাকি,
দ্বিদল যোজনী ভেঙে
হ্যাপ্লয়েডে মিশে যেতে থাকে
বর্ণ-গন্ধ-রস প্রকরণ
সেই অস্তিত্বের মতো
বাড়ে জনম বাহিত রোগ
যেন বিচ্ছিন্ন কুয়াশায়
পড়ে আছে অগণন মোহর ছাপ—
এই পুরো টাকশালে।

সেই অবিকল্প প্রেম
শুনায়েছে একদিন...
তার পাঁজরের কাছে
কার কত বড় ঋণ
শঙ্খের শরীরে তার অধিকার,
শ্রোণীতে বাঁধা বীজের ফানুস
আর এক তরবারি নিয়ে
চলে যেতে হবে বহুদূর
কোনো শস্যের কাছে।

সে চলে গেছে—
আর আমি!
আমি সত্যের পথে একা
হারায়েছি বেদ-বেদান্ত,
শ্রুত-অশ্রুত সব;
ততদিনে জেনে গেছি—
মৃতের বিস্ময়-চোখে
দেখেছি কতবার মাত্রা-সময়
গুণাংকের দ্বিঘাত বলয়ের নামে
কেটে রেখেছে সুরম্য গোর
ফসিলের ভাঁজে
সভ্যতার মতো লাশ!

দেখি শুধু প্রকৃতির বুকে
বেঁচে থাকে চর
আর এক অমর তরু
মূক জাতিস্মর
এই ধ্যানী বৃক্ষের প্রাণ,
ফোটনে লুকায়ে রাখে
পৃথিবীর যত গান;
অঙ্কুরোদগত বীজে
ঢাকা পড়ে থাকা বরফের যুগে
আগুনের মুখে;

আর আমি নিঃসীম প্রাণ
নিকটতম নক্ষত্র হতে এসে
এইখানে একা,
বুকে মৃতপ্রায় বামনের শ্লেষ
আর নক্ষত্রের দাগ নিয়ে দেখি,
স্তরের মতো সেজে আছে মেঘ;
আরো আরো প্রাণের মধ্যখানে
মগজের বড় স্তূপ
পিক্সেলে জমে ওঠা ডেন্ড্রয়েট এক্সন;
তড়িতাবেশ আর ভ্রামকের গতি নিয়ে
যেতে চেয়ে বহুদূর—
অরোরার কাছে গিয়ে
সব ফিরে ফিরে আসে।

ক্যান্ডেলায় মেপে রাখা আলোর পথে
তত্ত্বরা... তবু নিয়ে আসে দুধগঙ্গায়
দূর হতে দূরে— অস্পর্শ বলয়
দুটি সমান্তর জগৎ—
আছে সমান্তর সময়
আর তার সংঘাতে... কোল্ড স্পট
নিরালম্ব ক্ষয়,
শূন্যের স্থান মহাশূন্যময়!

তবু অবিচল সত্যের পথে
বাঁধা পড়ে থাকে সমুদয় জ্ঞান
বোঝা যায়...
অতত্ত্বেও অক্ষম থাকে ইতিহাস
অজ্ঞেয় এ অসীম, রহস্য সহজাত
স্বীকৃতি ও অস্বীকৃতির ওপরে উঠে থাকে
সত্যের `নু মেনা`...!

জ্ঞানের সীমার কাছে পরাহত
এই প্রাণ... ফিরায়ে রাখে মুখ,
পতনের পর থেকে
বিস্ময়-বিজ্ঞান হতে দূরে
বহুদূরে
শুধু চেতনার স্রোতের ভেতর
ভাসে রিভার্স মনোলগ
তবু কেন মনে হয়— প্রতিদিন
পুরোনো সূর্যের ভেতর
আসে নতুনতম দিন;

আবার মনে হয় ভ্রমের নামে
পড়ে আছি নিরুপায়
পরম্পরীণ দেজা ভ্যুর ভেতর
অনন্তকাল শুধু স্মৃতির ভেতর
অনন্তকাল শুধু স্মৃতি হয়ে!
মনে পড়ে অস্পন্দ সময় হতে
এইখানে আমি—
ঘটে গেছি যুগপৎ নামে,
কখনও জাতকের পুনর্জীবন
কখনও আলেকজান্দ্রিয়ার
গুমোট বাতাসে হিপাসিয়া কিংবা
পদ্মাবতী-পুষ্কর-মহাবোধি-কিন্নর
—এইসব নামের ভেতর;
শ্রাবস্তীর মঠ থেকে লাইস্যুম
লাইস্যুম থেকে একাডেমাস বাগান
—এইসব ধুলোয় ধুলায় আমি!
কখনও ভেবেছি—
নগন্য ইলা-ধীষণা-রাকা হয়ে আছি
কিংবা অদিতির মতো অক্ষয়,
আবার ঊষার মতো ডুবে গেছি
অভিমানে... এই বিপাশায়
কোনো একদিন,
জেগেছি শাকম্ভরীর মতো—
পুষ্পপত্র গর্ভ নিয়ে!

গ্রন্থের ধর্ম আর তার শ্রবণাগত সুর
কবে থেকে স্বজ্ঞার ভেতর,
কবে থেকে দেশ-কাল-অস্তিত্ব
আর সংখ্যার মতন, আমি জানি না!
নিকটতম নক্ষত্র নিয়ে পতনের পর
আমি ভুলে গেছি সেই নক্ষত্রের গান
ভ্রমান্ধের মতো—
অক্ষমতা পেয়ে গেছে
`অসীম` ও `অজ্ঞেয়` নাম!