প্রণব আচার্য্যের একগুচ্ছ কবিতা

প্রকাশিত : আগস্ট ১৩, ২০১৯

শোক প্রস্তাব

জীবনের পতনসমূহ এখনো নিকটবর্তী নয় বলেই এই শোক প্রস্তাব।
খুব ছেলেবেলায় একটি টিয়াপাখির পতন দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা কয়েকজন জেনেছিলাম, হত্যার জন্য মুখোমুখি যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই। শুধু নিখুঁত টার্গেটে ট্রিগার টিপতে জানলেই হয়।
প্রিয় বন্ধুগণ, মধ্যদিন আসন্ন। প্রায় পৌঁছে গ্যাছি। এখনো নিজেকে নির্মম প্রহৃত ভাবতে পারছি না। অথচ, আপনারা, আমার সুহৃদজন, এমনকি শত্রুগণও, কী চমৎকার উপভোগ করে চলছেন নিজস্ব পতন।

ভুলমুদ্রা

বেহুলা, তোমার স্বপ্নে ছিল ভুল অন্ধকার। দেখ, বীজগণিত থেকে সরে এসে আমরা জ্যামিতি আর ত্রিকোণমিতিতে কী সুন্দর চিনে নিতে শিখেছি পথ— হিসাব কষে নির্ভুল। তুমি নদীতে নদীতে হাড়ের শব বয়ে নিয়ে গিয়েছ, খোঁপার গহিনে লেজখণ্ড বয়ে নিয়েও কোনো উপপাদ্যেরই সঠিক প্রমাণে পৌঁছাতে পারোনি। না তুমি, না জীবন, কেউই বাঁচতে পারোনি। বেঁচে গ্যালো বামহাত সর্বস্ব চাঁদ। ইতিহাসে তার জাত্যাভিমানের নিপুণ জ্যামিতিক কাঠামোটি ঠিকই সুস্পষ্ট এখনো। সদম্ভে। তুমি বাঁচোনি। তোমার চোখে কোনো ত্রিকোণমিতি জ্যামিতি তুমি আঁকতে পারোনি। তাই রূপকথায় এসেও সেই একই ভুল করো। ভুল মুদ্রায় নাচ লম্পট ইন্দ্রের সভায়।

কয়েকটি পাখির ডাক ও অন্যান্য

আজ রাতে কয়েকটি পাখির ডাক শোনা যাবে তোমাদের তেমাথায়। সেখানে একটি গর্তের ভেতরে লুকানো রয়েছে আধেক গোধূলি রঙ। আজ রাতে গোধূলি দেখবেন যারা, তাদের স্মৃতিমালা রক্ষিত হবে প্রতি শতকের রৌদ্রতম দিনে। অধরা, অদৃশ্য হ্যাঙ্গারে ঝুলে আছি— আমায় শুষে নেবে শীতল আলখেল্লার গভীর কালো রঙ। নিঃশব্দে।

আর শেষতম দিনে আবার চন্দ্রোদয় হলে মুখোমুখি হবো আমরা দুজন। বাম আঙুল থেকে তুমি তুলে নেবে বস্তিবাসীর কুৎসিত সঙ্গম দৃশ্যরাজি। ঘৃণায় মুষড়ে পড়ার আগে জানাবে— বড় বেশি অপ্রমিত ছিল তোমার হাবভাব। সন্ধ্যার কিছু পর জেগে উঠবে গুটিকয় উদ্বিগ্ন মুখের সামনে; সেখানে আমার মুখমণ্ডলের কোনো প্রবেশাধিকার থাকবে না আর।

কয়েটি ইঁদুর দৃশ্যের মতো দেয়াল থেকে ঝড়ে পড়তেই ভূ-মণ্ডলে নেমে আসে হিম ঋতু। অনভ্যস্থ তুষারপাতে ভরে যায় আমাদের নাতিশীতোষ্ণ মাঠের সবুজ। রঙ বদলে যায়, বদলে যায় অনুভূতির সংজ্ঞার মতোন। বিষণ্ণ বিকেল মানে পড়ন্ত রোদের নিথর আলস্য নয়, এখন এখানে বরফের প্রাচুর্যে কোনো অনুভূতি অবশিষ্ট থাকে না আর— গভীর চাদর জড়িয়ে শুয়ে থাকা ছাড়া

রুপালি চোখ, আগুন আর বাম বাহুর টিকার দাগ

এখনো স্মৃতিভ্রষ্ট হই নাই।
পুকুরের ঢেউয়ে বালিশ সাজায়ে রাখা অন্যায় হবে— এরকমই বিধান ছিলো আমাদের শৈশবে; মানে মাননীয় এরশাদ যখন বন্যার পানিতে নেমে বাংলাদেশ টেলিভিশনের ক্যামেরার সামনে পোজ দিতেছিলেন।

এরকম শৈশব সবার আসে না। এরকম ডাহুক শিকার সবাই পারে না।
ফাঁদ পেতে বসে থাকতে হয় সুদীর্ঘকাল—

ছোট্ট একটা মাছের কথা এখনো মনে আছে; আধডুবো ধানের ভিতরে আশৈশব বসে থেকে মাছটির চোখের রূপালি রঙ চিনতে পেরেছিলাম। রূপালি পর্দার মতো ক্লাইমেক্সে ভরপুর সাঁতার প্রতিযোগিতা চলতেছিলো তখন সেই চোখে।

মাসকালাই গাছের ডালে টিয়ে যখন কামরাঙা খোঁজে
তখন বুঝতে হয় অনর্থ হয়ে গ্যাছে কোথাও; কোথায়?
হাফপ্যান্টের পকেটে এসবের কোন উত্তর থাকতো না।

মালতি। আমাদের মধ্যে তুইতো সবচে’ ভালো সাপলুডু খেলতি। সেজন্যই কি ওঝা সর্দার তোকে গোপন করেছিলো এক রাতের জন্য। ফিরে এসে আর কোনদিন লুডুর বোর্ডে হাত দিসনি। এবং তারপর থেকে তুই আগুন ভালোবাসতি খুউব। আমি জানতাম; আমরা দেখেছিলাম এক ভোরে আগুনের সাথে তোর ভষ্মদীর্ণ মিলন ছাই।

আমাকে কি তোর মনে আছে আফিয়া বানু? অন্ধচোখে কিভাবে স্বপ্ন দেখা যায়, আমাকে শেখাবি? আফিয়া, আফিয়া লো, তুইও শেষমেশ শিখে গেলি নাগরিক নিঃশ্বাস! ভুলে গেলি ভালোবাসার মতো আর কিছুই ছিলো না তোর, কেবল বাম বাহুর জ্বলজ্বলে টিকার দাগ ছাড়া— একটি নীরব কিশোর যার পাণিপ্রার্থী ছিলো।

কতটা উচ্ছন্নে গেলে মালতির স্বপ্নে সুরেশ নেমে আসে?
কতটা উচ্ছন্নে গেলে সুরেশের চোখে আফিয়ার স্বপ্ন দেখা যায়?

কলসেন্টারের কোকিল কণ্ঠীরা উত্তরহীন; নিঃশব্দে কাঁদে— জুন এর রোদের দুপুরে সড়কের পাশ ঘেঁষে বসে থাকা কুমোরের মাটির হাড়িতে এইসব শৈশব রক্ষিত আছে জেনে।