মামুন খানের বাছাই ২০ কবিতা

প্রকাশিত : মার্চ ০৯, ২০১৯

পাখিটা

এতক্ষণ তার মতোই সে ছিল বসে।

যেই দেখতে শুরু করলাম
সেও শুরু করে দিল গোছাতে তার পালক।
মনে মনে যেই বললাম, বাহ!
ডাল ছেড়েই সে দিল উড়াল!

ফেলে যাওয়া ডালটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে
মনে হচ্ছিল, বহুদিন কেউ এসে বসে না
এমন একটি ভাঙা বারান্দার সামনে দাঁড়িয়ে আছি।

আর ভেতরে, নির্জন  দুপুরটাকে কাঁপিয়ে
কেঁদে যাচ্ছিল একাকিনী একটা ঘুঘু...

উন্মাদের হস্তলিপি

উন্মাদের হস্তলিপি পাঠের আগে কিছু খেয়ে নেয়া ভালো।
তাহলে তার হিজিবিজি কালো কালো একান্নবর্তী সংসারের
নিজেকে ইজিলি ভাবতে পারবা বায়ান্নতম সদস্য।
অথবা তেত্রিশ কোটি নিরানব্বই হাজারদের একজন
সুকুমার শিবরাম সুলতান... আরও আরও
            তারপর তুমি।

নদীপাড়ে গিয়ে যদি শুধু পানির কথাই ভাবো
তাহলে তুমি পানিণীর কাছে যাও— যাও
হায়াৎ মামুদের কাছে
তারা স্পষ্ট করে বসে আছেন মাতাল আর উন্মাদের সুস্পষ্ট ফারাক।

যেমন ফারাক্কা— বাংলাদেশ: ইন্ডিয়া।
যেমন টুপি— মগজ আর মাথা: বাম আর জামাত।

যদি অক্ষম তুমি সুশৃঙ্খলিত যাবজ্জীবন দণ্ডভার সইতে
তবে পড়ে যাও ওপেন এয়ার কনসার্টের কবিতা
শুনে যাও যেকোনো ক্রেজি আন্ডারগ্রাউন্ড কিংবা
তুমুল জালাল খাঁ।

আর দেখতে চাইলে দেখে শিখতে চাইলে
বাংলাচার্য হেংলোপোংলো কাঁটা (তার) বিদ্ধ
ঋত্বিক তো আছেন-ই।

শূন্য

আমার সবচেয়ে সুন্দর দিনটিতে আমি থাকবো না।

আমাকে ঘিরে চারপাশে ফুটে থাকবে
        অজস্র নরম দৃশ্য—     
গন্ধ উড়বে, পাথর গলবে
প্রশংসাতরঙ্গে ‘হ্যাঁ’ ‘হ্যাঁ’ করে কাঁপবে বাতাস
মৃদু-পাপড়ি আর মৃত্তিকার বিক্ষত পরতে পরতে
বাজতে থাকবে অন্ধ-এস্রাজ...

শতদিক থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছুটে আসা শত শত স্বজন
ভেজা আকাশের ছায়া মেখে মুখে
দেখতে থাকবে আমাকে— আমার না-থাকাকে।

আমি দেখবো না এর কিছুই।
আমার কাছে এসবের কোনো মানেও আর থাকবে না।

আমি তো তখন এই মহাপ্রেক্ষাগৃহের সমস্ত
রঙ রেখা ঘ্রাণ প্রাণ ধ্বনি— সবকিছুকে একাকার করে দিয়ে
অতিকায় কালো একটা ‘শূন্য’ হয়ে যাব।

চিরন্তন মানচিত্র

খনিজজৌলুসে ভরতি তোমার ভূগোল।
লক্ষ লক্ষ শ্রমিক যুগ-যুগ ধরে খুড়ে যাচ্ছে
তবু একটুও হিজিবিজি হচ্ছে না তোমার মানচিত্র।

তোমার পরতে পরতে লুপ্ত হয়ে থাকা
তরবারির খণ্ডিত ডগা
    রক্তাক্ত মখমল
        ক্ষয়ে যাওয়া তুলি
            ফেনিল পুঁথি
সবকিছু পায়ে দলে এগিয়ে যাচ্ছে শ্রমিকের দল।

তাদের নিঃশ্বাস যত দ্রুত আর ক্লান্ত হচ্ছে
ততই তুমি উজ্জ্বল হয়ে উঠছ দিন দিন...

আগুন অথবা আনন্দ

সৌরবিশ্বের সর্বশেষ সভ্যতার নাম— গুহা!

গুহার মুখে যার মশালের যত বেশি আগুন
তিনি তত মস্ত দেবতা।

গোলাপি শৈশব থেকেই তারা জেনেছে— তাদের প্রথম দাদিমা
আগুনের কাছ থেকেই শিখেছিল উপাস্যের ভাষ্য
আগুনের কাছেই প্রথম হয়েছিল—
            চিৎ, উপুৎ ও আনত।

তারা মানে, আগুনই শেষ পুরান, শেষ মিনার
            সর্বশেষ আনন্দ...।

সংসার

সন্ধ্যার আগে সারাদিন নানান ভঙিতে
এলোমেলো হয়ে থাকে জীবন।

থুথুর ফেনা জুতোর ধুলি নখের আঁচর গায়ে মেখে
যখন ফিরে আসি ঘরে
রাতের গায়ে একবিন্দু মোম জ্বালিয়ে
আলোর ওপাশে বসে থাকে বউ।

আলোর মতো নরম করে সে হাসে
নরম দু‘হাতে ভাঁজ করে দেয়
সারাদিনের এলোমেলো জীবন।

লোমের গোড়ায় জমে থাকা ঘামের গায়ে তখন
মনে হয় বসে আছে মাঝ-সমুদ্র থেকে উড়ে আসা
একঝাঁক শীতল ডানার পাখি...

জিতসোমা

কখনো কখনো ব্যকুল হয়ে উঠি
শিশুর সারল্যে কোলের দিকে তোমার
বাড়িয়ে দিই হাত।

ব-দ্বীপ প্লাবিত পলি, উল্ডিতলশোভিত জবা আর
দুপুরের বটছায়াময় তোমার অই কোল
জানি আমাকে নেবে না!

প্রতীচ্য আগুনে পুড়ে যাচ্ছে তোমার সিন্ধুমায়া
বুকে তোমার কমে যাচ্ছে দুধের প্রবাহ
জেগে উঠছে চর— সেখানে বাঁধছ ঘর
                    এক বসন্তের জন্য!

আমি অনার্য বালক তবু তোমার কোলের জন্যই
বাড়িয়ে রাখি হাত।

জিতসোমা- ৯

কামিনীর ঝোপ থেকে জানালায়
হামলে পড়ছে হাওয়ার পর হাওয়া ঘ্রাণের পর ঘ্রাণ—
এমনই খাপে খাপে ঠাট করা রাত।

ডানা থেকে যখন সরে গেল
সমর্পণাচ্ছন্ন পালকের শিহরণ
আধোভেজা কেশরের আড়াল থেকে যখন
        আমিও গুটিয়ে নিলাম তৃষ্ণা—

মনে হচ্ছিল, দমবন্ধ হিম একটা মহাকাল
কত যুগ যেন থমকে থেকে
মোমের আলোর পাশ ঘেঁষে
কোথায় যেন মিলিয়ে গেল হঠাৎ!

আমি পাথর থেতলানো আহত প্রাণীর মতো
একটু সোজা হয়ে কী যেন বলতে চাইছিলাম—

যখন বলছিলে— ‘মানুষ কত আজব, না?’

 

জিতসোমা- ১৪

রঙের আড়ালে মাটি
মাটির আড়ালে খড়
খড়ের আড়ালে খণ্ডিত বাঁশ
        —এ সবকিছুকে ছাপিয়ে যে তুমি
         মোহিত করে রাখছ মণ্ডপ
         আমিই তার শিল্পী।

তোমার চারপাশ উচ্চ উলুধ্বনি আর ধূপধোঁয়ায় আচ্ছন্ন।
দূরে, অস্পষ্ট দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আমাকে
                     মনেই নেই তোমার!

লগ্নশেষে চারদিকে যখন
তোমাকে ঘিরে বেজে উঠবে বিসর্জনের কোরাস
পৃথিবীতে একটিমাত্র মুখ
বিষাদে নত হয়ে থাকা একটি মুখ
দেখতে যদি চাও
আমার দিকে তাকিয়ো একবার।

আমি যে কারিগর তোমার!

বাদক

হলভর্তি নক্ষত্রের সামনে আমাকে বাজাচ্ছো তুমি

তোমার আঙুলের আনন্দে
লাফাতে লাফাতে কোনো কোনো নক্ষত্র
ছুটে আসছে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের দিকে

মহানক্ষত্রালোক থেকে ভেসে আসা করতালির শব্দে
আর মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে পৃথিবী

কেঁপে উঠছে তোমার আঙুল

কবর

একটু আগে ভূ-গর্ভে ঠেলা দেয়া হয়েছে আমার আব্বাকে
নক্ষত্রের দিকে হাত রেখে আমরা এখন
তাঁর শান্তিময় ভূ-গর্ভবাসের প্রার্থনায় আছি

প্রার্থনায় আমরা যা-ই বলছি না কেন
আমরা জানি, স্থানটি শিয়াল শকুন থেকে নিরাপদ
ভূ-পৃষ্ঠের বায়ুমণ্ডলকেও রাখবে স্বাভাবিক

কবর- ২

দু’ফসলা জমিটির এক কোণে
নবীন-প্রবীণ অনেকগুলো কবরকে ভাবছি
ভাবছি পৃথিবীতে জমিগুলোর এরকম
লক্ষ লক্ষ কবরকে ভুলে যাওয়ার কথা—

হয়তো ভুলে যাওয়া অসংখ্য পিতার ঊর্বরতা
আজো লাঙ্গলে লাঙ্গলে ফিরে আসে
        আমাদের ফসলে ফসলে

তালাচাবি

বাইরে থেকে ফিরে রুমের তালায় চাবি
ঢুকাতে ঢুকাতে অনুভব করি অন্যরকম পুলক
রুমের ভেতরে তো একই রকম পরিচিত সব
তবু মনে হয় নতুন কিছুতে প্রথম প্রথম ঢুকছি

চাবি যে কী করে তালার
আজন্ম কঠোর কাঠিণ্যকে শিথিল করে ফেলে
তা আমি না বুঝেও বুঝি যে এদের
        খাপে খাপে মিলে যাওয়াটাই ঘটনা

এই সামান্য ঘটনা ঘটার আগে
ক্যান যে এত খাটাখাটি লাগে!

শেষ ঋতুর হাওয়া

বেড়ায় আড়াল হয়ে আছে বাগান
বাগানে গোপন হয়ে আছে ফুল

বেড়ার আশপাশে উড়ছে একজোড়া ভ্রমর
বাগান আর ভ্রমরের মাঝখান দিয়ে বইছে
শেষ ঋতুর হাওয়া

ভ্রমর জানে আড়াল-মধুর মাধুরী বেশি:
বাগান কী জানে বেলা পড়ে গেলে
        তৃষ্ণা যে থাকে না ভ্রমরের!

গানওয়ালা

বিষণ্ণ একতারার পাশে বসে আছে অন্ধ এক গানওয়ালা

সে জানে— চৈত্রের হাওয়া যতই উড়াক ধূলি
রোদে যতই পোড়াক লোকালয়
এই গানের কাছে কেউ না কেউ এসে দাঁড়াবেই

সে জানে তার আঙুলের চেয়ে এমন মৌন ছন্দে
আর কে পারবে বাজাতে ধূলির মতো পতিত প্রাণ
তার গলার চেয়ে আর কে পারবে
এমন নম্র সুরে বোঝাতে বেদনা কারে কয়!

মানুষ যতই আনন্দবিলাসী হোক
সে জানে রোদনের চেয়ে মধুর কোনো সান্ত্বনা নেই!

ওম

শাদা খোলসের নম্র যে ওম
তার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসলো
        উগ্র লাল এক লেপ
বালিকা তা ছড়িয়ে দিলো ছাদে—

বোঝা গেল— ওমেরও ওম প্রয়োজন
যা নিতে হয় খোলশ মুক্ত করে
যা হতে হয় আরো উগ্র আরো তীব্র...

ওম- ২

শীত এলেই বেড়ে যায় কোলবালিশের ব্যঞ্জনা
তার ওমের ঘোরে বিভ্রান্ত রাত যেন
        কাটতেই চায় না

দিনের বেলায় কণ্টকিনী শিমুলের পায়ের কাছে বসে
        প্রার্থনার মতো তাই কাঁদি—
‘আসছে শীতে বোন তুমি মাংস প্রসবিনী হইয়ো!’

কৃষক

বাতাসের মুখোমুখি বসে আছে আমার শরীর
        আমার মন জানে এই বসন্তসন্ধ্যাটি
জ্যোৎস্নাহীন হয়ে যাবার আগে
পৃথিবীর ছোট ছোট শহরগুলো থেকে
বোরো সবুজের মতো কুমারীরা
নেমে আসবে আমাদের মাঠে মাঠে...

মাঠের মুখোমুখি কৃষকটি আমার মন।

গৃহিনী

শেষ বয়সী ডাঁটাটায় ঝুলে থাকা
যুবতী শিমগুলোর
অক্ষত বৃদ্ধা বয়স প্রার্থনা করছেন আমাদের মা

আমাদের দীর্ঘ বয়সী মা জানেন
শিমগুলোর প্রত্যেকটির রয়েছে
চারটি পাঁচটি করে অপার ভবিষ্যৎ।
আমাদের পাড়ায় পাড়ায় চালে চালে
মাচায় মাচায় অসীম সবুজের নিশ্চয়তা

চেয়ার

কেউ এসে বইসা পড়তে পারে— এই ভয়ে
কেউ-ই ছাড়ছেন না চেয়ার

ত্যাগের বেগ নিয়েও প্রকৃত সুখ থেকে তারা
বঞ্চিত আজ এই একমাত্র চেয়ারেরই কারণে

একমাত্র চেয়ারকেই তারা এই জীবনে মেনেছেন সার

তারা পশ্চাৎ দেবেন তবু ছাড়বেন না চেয়ার!