
প্রতীকী ছবি
রাষ্ট্র কাঠামো ও ব্যবস্থার পরিবর্তনের কোনো বিকল্প নেই
পর্ব ১
আবু সাইয়ীদপ্রকাশিত : ডিসেম্বর ২১, ২০১৯
বুদ্ধি বিবেচনায় এমন কোনও অন্ধ মানুষ পাওয়া যাবে না, যিনি মনে করেন, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ ঠিকঠাক মতো চলছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, এমন অনেক রাষ্ট্রই আছে পৃথিবীতে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, কতিপয় ব্যক্তি বিভিন্ন পদমর্যাদা নিয়ে রাষ্ট্রের নামে একটি ভূখণ্ডের মালিক হয়ে যান এবং ওই ভূখণ্ডের সকল প্রজা হয়ে যায় তাদের শ্রমিক-কর্মচারী এবং আয়-রোজগারের হাতিয়ার। রাজতন্ত্র গেছে বটে কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর নামে শাসনের আসনে জেঁকে বসেছেন নতুন এক রাজা। অর্থাৎ বর্তমানের রাষ্ট্রপতি অথবা প্রধানমন্ত্রীকে বলা চলে, নব্যরাজা। পার্থক্য একটাই, রাজার আমলে রাজা হতেন রাজ পরিবারের কেউ, আর এখন এই সকল রাজাসম রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী হন তথাকথিত নির্বাচনের মাধ্যমে।
নির্বাচনের আগে নব্যরাজাগণ জনগণের দ্বারে উপস্থিত হন বটে, নির্বাচিত হবার পর আবার সেই রাজকীয় আস্ফালন। এদের কত সিপাহী, কত পাইকপেয়াদা, আরও কত কি! এদের মুখের উচ্চারণই আইন এবং তা সকলের জন্য শিরধার্য্, অনেকটা রাজার আমলে যা ছিল, ঠিক তাই। রাজার আমলে যা ছিল প্রত্যক্ষ, এখন তা পরোক্ষ— পার্থক্য এটুকুই।
বাংলাদেশের সংকটের শেষ নেই। বাংলাদেশে সংকটের যেমন শেষ নেই, তেমনি কিছু মানুষের প্রতিবাদেরও শেষ নেই। বাংলাদেশের মানুষের বড় বৈশিষ্ট্য হলো, মনেপ্রাণে প্রায় সকলই প্রতিবাদী। এত বেশি ঘটনা ঘটে যাচ্ছে প্রতিদিন যে, প্রতিবাদের ক্ষেত্র এবং সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলছে। সকালে বাক-স্বাধীনতা, তো বিকেলে ধর্ষণ, রাতে হত্যা তো পরদিন দুর্নীতি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, ব্যাঙ্কলোপাট, শেয়ার মার্কেট, পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি ঘটিয়ে টাকা হাতিয়ে নেয়া, শিক্ষা ও চিকিৎসায় অব্যবাস্থা, আরও কত কি! যেন নাটকের প্রতিটি অঙ্ক উত্তেজনায় ঠাসা। তাহলে প্রশ্ন, বাংলাদেশে কেন যুগযুগ ধরে নব্যরাজারাই দেশ শাসন করছেন? যে দেশের মানুষ এত উত্তেজিত, এত প্রতিবাদী সেই দেশে কেন রাজার পর রাজাই আসেন?
গ্রীক দেশে একদা সোফিস্টরা চিন্তাচেতনায় বহুত্বে বিশ্বাসী ছিলেন, তা ছিল তৎকালীন শাসকদের জন্য কাল। তৎকালীন শাসকরা চাইতেন প্রজাদের একমুখী ভাবনায় আবদ্ধ রাখতে, তাতে শাসনকার্যে সমূহ সুবিধা হতো। আর আজকের বাস্তবতায় শাসকদের চাওয়া, প্রজারা ভাবনা ও প্রতিবাদের বহুত্বে ঘুরপাক খেতে থাকুক। তাতে একটু নয়েজ তৈরি হয় বটে, কিন্তু মূল লক্ষ্যে প্রজারা পৌঁছুতে পারে না। বর্তমানে আমরা বাংলাদেশের মানুষেরা তাই করছি, বিভিন্ন ইস্যুতে প্রতিবাদ করছি কিন্তু মূলে পৌঁছুতে পারছি না। আমাদের স্বপ্নের রাষ্ট্রের সন্ধান আমরা পাচ্ছি না।
তাই আমি ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, আমাদের যে বিষয়টা প্রথমে বিবেচনায় আনতে হবে তা হলো, রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন। বর্তমানে বাংলাদেশে যে রাষ্ট্র ব্যবস্থা বিরাজমান তাতে নব্যরাজার খপ্পর থেকে কোনোদিন বাংলাদেশ মুক্তি পাবে না। তাই ইস্যুকেন্দ্রিক আমাদের যে প্রতিবাদ তা যদি রাখতেও হয়, তার উপরেও বিবেচনায় নিতে রাষ্ট্র ব্যবস্থার পরিবর্তনের আন্দোলনকে। যদি ইস্যুভিত্তিক প্রতিবাদকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র রাষ্ট্র ব্যবস্থার পরিবর্তনের আন্দোলনকে একমাত্র গুরুত্ব দিয়ে অভিষ্ট্য লক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভব হয় তাহলে যে সকল ইস্যু নিয়ে আমরা সোচ্চার, সেই সকল ইস্যুকে তিরোহিত করা সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি।
একটি ভালো রাষ্ট্র গঠনের জন্য যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি জরুরি তা হলো, রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ এবং নির্বাহী বিভাগ এই তিনটিকে সমক্ষমতায় কার্যকরি রাখা, এই তিনটি অঙ্গের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। যা বাংলাদেশে একেবারেই অনুপস্থিত। এছাড়া এই তিনটি অঙ্গের মধ্যে অভ্যন্তরীণ ভারসাম্যও থাকতে হবে, যাও বাংলাদেশে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।
এক বা দুটি বাহু দিয়ে কখনো ক্ষেত্র তৈরি হয় না, প্রয়োজন হয় তিনটি বাহুর। আর তিনটি বাহু দিয়ে সুষম ত্রিভুজের জন্য প্রয়োজন সমান তিনটি বাহু। ক্ষেত্র বিবেচনায়, ত্রিভূজ, চতুর্ভূজ, বহুভূজের মধ্যে উৎপাদিত ক্ষেত্রের মধ্যে ত্রিভূজ এবং বিবিধ ত্রিভূজের মধ্যে সমবাহু ত্রিভূজ সবচেয়ে শক্তিশালী ক্ষেত্র। তাই বর্তমান সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এনে আমাদের চিন্তা করতে হবে আমরা কোন পদ্ধতিতে গেলে এই তিন অঙ্গের যথাযথ ভারসাম্য রক্ষা করতে পারি এবং তিনটি অঙ্গের সমশক্তিতে রাষ্ট্রীয় কাঠামো গড়ে তুলতে পারি।
বিশেষজ্ঞরা ভাববেন বটে কিন্তু সাধারণ সংবেদনশীল মানুষকেও ভাবতে হবে আমাদের রাষ্ট্র আমরা কিভাবে গঠন করবো। একটা উদাহরণ দেই, ধরা যাক বিচার বিভাগ। বাংলাদেশে যে প্রক্রিয়ায় বিচার বিভাগ গঠিত হয়ে থাকে তাতে শক্তিশালী এবং স্বাধীন বিচার বিভাগ গঠন করা অসম্ভব। বর্তমানে বিচার বিভাগের উপর রাজনৈতিক এবং নির্বাহীবিভাগের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাবের কথা আমরা কমবেশি সকলেই জানি। তাই আমি মনে করি, বিচার বিভাগের উপর রাজনৈতিক এবং নির্বাহীবিভাগের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব কমাতে হলে এবং বিচার বিভাগকে স্বাধীন ও অন্য অঙ্গের সাথে সমক্ষমতাসম্পন্ন করতে চাইলে বিচার বিভাগের গঠন প্রক্রিয়ার দিকে প্রথমেই নজর দিতে হবে।
উচ্চ আদালতের দুটি বিভাগ রয়েছে, হাইকোর্ট বিভাগ এবং আপিল বিভাগ। হাইকোর্ট বিভাগে দুই পার্যায়ে বিচারপতিরা নিয়োগপ্রাপ্ত হন, প্রথম পর্যায়ে সাধারণত উচ্চ আদালতের আইনজীবী এবং জেলা ও দায়রা জজদের মধ্য থেকে অস্থায়ী বিচারপতি, দ্বিতীয় পর্যায়ে দুই বছর পর অস্থায়ী বিচারপতিরা স্থায়ীভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। আপিল বিভাগের বিচারপতি নিয়োগপ্রাপ্ত হন হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিদের ভেতর থেকে। সর্বোপরি প্রধান বিচারপতি নিয়োগপ্রাপ্ত হন আপিল বিভাগের বিচারপতিদের ভেতর থেকে। বলা চলে বিচার বিভগে চার পর্যায়ে নিয়োগপ্রাপ্তি ঘটে থাকে।
আমরা যদি বিবেচনায় আনি যে, উচ্চ আদালত বিচারক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনা জরুরি তাহলে কি হতে পারে নতুন প্রক্রিয়া? ধরে নেই, হাইকোর্ট বিভাগে নতুন পাঁচজন অস্থায়ী বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হবে। এক্ষেত্রে আমি আমার মতো করে একটি প্রস্তাবনা করছি, যা অনেকটা এইরকম—
প্রথম ধাপে আপিল বিভাগ, উচ্চ আদালতের প্রবীণ আইনজীবীদের মধ্য থেকে দশজনকে নির্বাচন করবেন, যারা উচ্চ আদালতের আইনজীবীদের মধ্যে থেকে যোগ্য সাতজনের নাম বাছাই করে হাইকোর্ট বিভাগে পাঠাবেন।
দ্বিতীয় ধাপে হাইকোর্টের বিচারপতিরা এই তালিকার মধ্য থেকে সবাইকে রাখতে পারেন অথবা তিনজনকে পরিবর্তন করে উচ্চ আদালতের নতুন তিনজন আইনজীবীর নাম যুক্ত করে মোট সাতজন এবং জেলা ও দায়রা জজ অথবা অন্য কোনও দায়িত্ব পালন করেছেন, এমন তিনজনের নাম অন্তর্ভুক্ত করে মোট দশজনের নাম আপিল বিভাগে প্রেরণ করবেন।
তৃতীয় ধাপে প্রধান বিচারপতি ব্যতীত আপিল বিভাগের অন্য বিচারপতিরা এই তালিকা থেকে সাতজন অথবা ছয়জন এবং নতুনভাবে আরও একজনের নাম যুক্ত করে মোট সাতজনের নাম প্রধান বিচারপতির কাছে প্রেরণ করবেন।
চতুর্থ ধাপে প্রধান বিচারপতি এই সাত জনের মধ্য থেকে পাঁচজন অথবা চারজন এবং নতুনভাবে একজনের নাম যুক্ত করে মোট পাঁচজনের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে আস্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগদানের জন্য পাঠাবেন।
আমি যে প্রস্তাবটি উপস্থাপন করলাম তা আমার একান্ত ব্যক্তিগত ভাবনার প্রাথমিক প্রকাশ। যারা বিচার বিভাগে ছিলেন বা আছেন, যারা আইন পেশার সাথে জরিত, যারা শিক্ষকতা করেন বা অন্যকোনও ব্যক্তি যিনি এ বিষয়ে আরও ভাল ধারণা রাখেন, তিনি নিশ্চয় আরও গঠনমূলক এবং উত্তম ভাবনা উপস্থাপন করতে পারবেন। আমি এ পর্যায়ে যা করতে চাচ্ছি তা হলো আমাদের চিন্তার জগতে উদ্ভাবনামূলক ধারণাকে ঠাই দেয়া এবং এর চর্চা করা। এছাড়া স্থানিক প্রয়োজনীয়তাকে উপলব্ধি করা।
লেখক: চিত্রনির্মাতা