রাষ্ট্র কাঠামো ও ব্যবস্থার পরিবর্তনের কোনো বিকল্প নেই

পর্ব ২

আবু সাইয়ীদ

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২২, ২০১৯

সুশাসনের জন্য, সকল স্তরের জনগণের অধিকার রক্ষার প্রয়োজনে, ক্ষমতাবানদের দায়িত্ববান করতে একমাত্র গুরুত্ব দেয়া উচিত রাষ্ট্রীয় কাঠামোর এবং ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনকে। প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন এই গুরুত্ব?

যদি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর এবং ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন না ঘটিয়ে শুধুমাত্র দায়িত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা সরকারের পরিবর্তন ঘটানো হয়, তা হয়তো সাময়িক বা নির্দিষ্ট দু’একটা বিষয়ে এক ধরনের পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগতে পারে, কিন্তু স্থায়ীভাবে সুশাসনে, সকল স্তরের জনগণের অধিকার রক্ষা, ক্ষমতাবানদের দায়িত্ববান করা সম্ভব হবে না।

১৯৯০ সালে গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচার এক সরকারের পরিবর্তন ঘটে, শুরু হয় বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন এক অধ্যায়ের। রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার পদ্ধতি পরিবর্তিত হয়ে চালু হয় সংসদীয় গণতন্ত্র। একে একটি কাঠামোগত পরিবর্তন বলা চলে। কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় ক্ষমতা প্রয়োগের দিক থেকে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে কোনও তারতম্য ঘটে না।

১৯৯১ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত যদি আমরা বিচার বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখতে পাবম, ক্ষমতা একটি জায়গায় কেন্দ্রীভূত থেকেছে। ক্রমাগত তা গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। সুশাসন, সকল স্তরের জনগণের অধিকার রক্ষা, ক্ষমতাবানদের দায়িত্ববান করার ক্ষেত্রে কোনও পরিবর্তনই ঘটেনি।

আমরা যদি আরব বসন্তের দিকে তাকাই তাহলে এক নির্মম বাস্তবতা দেখতে পাব। শুরু হয়েছিল শাসক উৎখাতের আন্দোলন। আন্দোলনে সফলতাও আসে, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। কিন্তু বর্তমানে যে শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতায় আছেন, আগের শাসক গোষ্ঠির সাথে তার মৌলিক কোনও পার্থক্য নেই। যদি আন্দোলনটি শাসক পরিবর্তনের পাশাপাশি, এরচেয়ে অধিক গুরুত্ব দেয়া হতো রাষ্ট্রীয় কাটামোগত পরিবর্তনকে তাহলে আরব বসন্ত শুধুমাত্র তথাকথিত শাসক পরিবর্তনের আন্দোলনে পর্যবসিত হতো না।

মিশরবাসী এবং সেখান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেক দেশের জনগণ পেত এমন একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থা যেখানে সুশাসন, সকল স্তরের জনগণের অধিকার রক্ষা, ক্ষমতাবানদের দায়িত্ববান করা সম্ভব হতো। দুর্ভাগ্য যে, এখন পর্যন্ত সকল আন্দোলন ঘুরপাক খাচ্ছে কিছু ইস্যু এবং সরকার পরিবর্তনের আন্দোলনের মধ্যে। এই বিষয়টা আমলেই নেয়া হচ্ছে না যে, শুধু সরকার পরিবর্তনে কোনও সুফল আনবে না, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় এমন এক পরিবর্তন আনতে হবে যা রাষ্ট্রকে যথাযথভাবে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় রূপান্তরিত করবে।

প্রতিটি ব্যবস্থার এক ধরনের সীমাবদ্ধতা আছে এবং তাই সময়ের সাথে সাথে কখনো ছোট পরিসরে, কখনো বড় পরিসরে, আবার কখনো ঘটাতে হয় এর আমূল পরিবর্তন। রাষ্ট্র ব্যবস্থাও এর বাইরে নয়। এক সময় রাষ্ট্রহীন সমাজ ছিল, পরবর্তীতে রাষ্ট্র গঠিত হয়। অনেক চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে রাজতন্ত্র স্থিত হয় এবং সহস্রাধিক বছর ধরে এই ব্যবস্থা তার আবেদন ধরে রাখতে পারে। গণতন্ত্রের চর্চা দুই হাজার বছর আগে শুরু হলেও দুইশো বছরের অধিক সময় থেকে এই ব্যবস্থা বিকশিত হতে থাকে এবং ব্যপকতা লাভ করে।

গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা বলে যে শাসন ব্যবস্থা প্রচলিত আছে তা সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই হোক আর রাষ্ট্রপতি শাসিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, বা অন্য কোনও ব্যবস্থাই হোক, এই ব্যবস্থার বেসিক রূপরেখা দাঁড়াতে শুরু করেছে এই সময় থেকেই।

তবে গণতন্ত্রকে জনগণের শাসনব্যবস্থা বলা হলেও শাসক শ্রেণি প্রতারণা করে গুটিকয়েক সুবিধাবাদী মানুষের স্বার্থ রক্ষার জন্য এই এই রাষ্ট্রব্যবস্থা ব্যবহৃত হচ্ছে। এখন সময় এসেছে ভাবার, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নামে যে শাসন ব্যবস্থা চলছে তাকে প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলা যায় কিনা। আমার ধারণা, অধিকাংশ মানুষ বর্তমান প্রচলিত ব্যবস্থাকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হিসেবে আখ্যায়িত করবে না। সার্বিক বিচার বিশ্লেষণের পর হাতে গোণা দুই-চারটি দেশকে স্পিরিটের দিক থেকে কিছুটা ঠিকঠাক মনে হলেও অধিকাংশ দেশকে গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে আখ্যায়িত করার কোনও সুযোগ নেই; বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের অবস্থা তো ভয়াবহ।

উল্লেখ্য, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিকাশের মাঝেই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা আত্মপ্রকাশ করলেও রাষ্ট্রীয় কাঠামো হিসেবে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার চেয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অধিকতর উত্তম, তা বলাই যায়। তবে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে সমাজতন্ত্রের চমৎকারিত্যের তার জুড়ি নেই। এটি অবশ্য ভিন্ন এক আলোচনা। বর্তমানে প্রচলিত সংসদীয় ব্যবস্থায় সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, দু’একটি ব্যাতিক্রম বাদে প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদ নেতা একই ব্যক্তি হয়ে থাকেন এবং সংসদের গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী সদস্যরাই কেবিনেট সদস্য হয়ে থাকেন। এতে আইন বিভাগ এবং নির্বাহী বিভাগ একই ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয় বলে ধরে নেয়া যায়।

সংসদ সদস্যরা বিবিধ কারণে সর্বদা প্রধানমন্ত্রীর আনুকূল্য পেতে সচেষ্ট থাকেন। প্রধানমন্ত্রীর চাওয়া বাস্তবায়নই তাদের একমাত্র আরাধনা হয়ে থাকে। উন্নত দেশগুলিকে দুইয়ের ভারসাম্য কিছুটা, ক্ষেত্রে বিশষে অনেকটা রক্ষা পায় বটে কিন্তু তৃতীয় বিশ্বে দুইয়ের ভারসাম্য বলে কিছু নেই। প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদ নেতা একই ব্যক্তি হবার কারণে দুটিকে একই অঙ্গ বলা চলে।

এখানেই আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বের সাথে ভাবার বিষয় যে, কোনও পদ্ধতিতে নির্বাহী বিভাগ এবং আইন বিভাগকে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে পরিচালনা নিশ্চিত করা যায়। সারা বিশ্বের বর্তমান সার্বিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা বিবেচনায় আনলে এর কাঠামোগত পরিবর্তনের সময় এসেছে; ধারণা করা যায় যে, আমার সাথে অনেকেই একমত হবেন। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার কাঠামো পরিবর্তনের দিকে গুরুত্ব না দিয়ে শুধুমাত্র যদি সরকার পরিবর্তনের দিকেই আমাদের দৃষ্টি থাকে, তা নির্বাচনের মাধ্যমেই হোক বা আন্দোলনের মাধ্যমেই হোক, তা কখনোই যে আমাদের জন্য সুফল বয়ে আনবে না, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।

আমরা চাইবো, এটি গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু কিভাবে তার প্রাপ্তি ঘটবে তার রূপরেখা দাঁড় করনো অধিক গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের কাজ করা উচিত সেই লক্ষ্যেই। আমি আগেও বলেছি আবারও বলছি, প্রতিটি বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা ভাববেন বটে কিন্ত সংবেদনশীল মানুষেরাও এই ভাবনাপ্রক্রিয়ায় যুক্ত হবেন। ভাববেন তিনিই, যিনি ভাবতে চান, যিনি ভাবতে পারেন। এই ভাবনা এবং আলোচনা পর্যালোচনার মধ্য দিয়েই পৌঁছানো সম্ভব হবে অভিষ্ঠ লক্ষ্যে। চলবে

লেখক: চলচ্চিত্র পরিচালক