রাষ্ট্র কাঠামো ও ব্যবস্থার পরিবর্তনের কোনো বিকল্প নেই

শেষ পর্ব

আবু সাইয়ীদ

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২৩, ২০১৯

বিভিন্ন দেশে বর্তমান রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে আইন বিভাগ এবং নির্বাহী বিভাগ আলাদা দুটি অঙ্গ হলেও আইন বিভাগ নির্বাহী বিভাগের প্রয়োজনই মিটিয়ে থাকে। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বসহ বেশ কিছু দেশে। এর আগে বলেছিলাম, একটি ভালো রাষ্ট্র গঠনের জন্য যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি জরুরি তা হলো, রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ এবং নির্বাহী বিভাগ, এই তিনটিকে সমক্ষমতায় কার্যকরি রাখা, এই তিনটি অঙ্গের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা।

আরও বলেছিলাম, বর্তমান সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এনে আমাদের চিন্তা করতে হবে আমরা কোন পদ্ধতির মধ্য দিয়ে এই তিন অঙ্গের যথাযথ ভারসাম্য রক্ষা করতে পারি এবং তিনটি অঙ্গের সমশক্তিতে রাষ্ট্রীয় কাঠামো গড়ে তুলতে পারি। বিশেষজ্ঞরা ভাববেন বটে কিন্তু সাধারণ সংবেদনশীল মানুষকেও ভাবতে হবে আমাদের রাষ্ট্র আমরা কিভাবে গঠন করবো। বরাবরের মতো এ ভাবনা থেকে আমি সরে আসিনি। কাঠামো গঠনের উদাহরণ হিসেবে আমাদের রাষ্ট্র প্রথম পর্বে বিচার বিভাগে বিচারক নিয়োগের একটি প্রাথমিক ধারণা উপস্থাপন করেছিলাম। আমি এই পর্বে আইন বিভাগ এবং নির্বাহী বিভাগকে কিভাবে স্বতন্ত্র দুটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করানো যায়, তার একটি প্রাথমিক ধারণা উপস্থাপন করব।

আবারও বলছি, আমার ধারণাগুলো একান্ত ব্যক্তিগত ভাবনার প্রাথমিক প্রকাশ। যারা রাষ্ট্র নিয়ে আরও গভীরে ভাবেন, তারা নিশ্চয় আরও গঠনমূলক এবং উত্তম ধারণা উপস্থাপন করতে পারবে। আমি এ পর্যায়ে যা করতে চাচ্ছি তা হলো, আমাদের চিন্তার জগতে উদ্ভাবনামূলক ধারণাকে ঠাই দেয়া এবং এর চর্চা করা। এছাড়া স্থানিক প্রয়োজনীয়তাকে উপলব্ধি করা। সর্বসাধারণকেও বৃত্তের বাইরে গিয়ে ভিন্নভাবে ভাবনায় উদ্বুদ্ধ করা।

স্বতন্ত্র আইন বিভাগ এবং নির্বাহী বিভাগ নিয়ে আমার যে ভাবনা তা নিম্নরূপ:

বর্তমান প্রচলিত ব্যবস্থার মতোই সাধারণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আইন বিভাগ এবং নির্বাহী বিভাগ গঠিত হবে। আইন বিভাগের কথা ধরা যাক, বর্তমানের মতো নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তিনশো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবেন কিন্তু পার্থক্য যা থাকবে তা হলো, বর্তমানের তিনশো সংসদীয় আসনের পরিবর্তে দেড়শো সংসদীয় আসন থাকবে। এই দেড়শোটি সংসদীয় আসনে যে দেড়শোজন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবেন তারা নির্বাচন করবেন কোনও দল, জোট অথবা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে। ৫০ জন প্রার্থী নির্দিষ্ট কোনও আসন থেকে নির্বাচত হবেন না। এই ৫০ জন সংসদ সদস্য হবেন কোনও দল বা গোষ্ঠির প্রাপ্ত ভোটের শতকরা হিসেবে। তবে নির্বাচনের আগেই দল বা জোট ২৫ জন প্রার্থীর নাম ঘোষণা করবে, যাদের মধ্য থেকে ভোটের অনুপাতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবেন।

বিষয়টা এমন, ধরা যাক ক দল শতকরা পঞ্চাশভাগ ভোট পেল। তাদের ২৫ জন প্রার্থীর মধ্য থেকে ২৫ জন সংসদ সদস্য হবেন। কিন্তু কোনও দল বা জোট যদি ৫০ ভাগের অধিক ভোট পায়, ধরা যাক ভোটপ্রাপ্তির অনুপাতে সেই দল বা জোট থেকে ৩০ জন সংসদ সদস্য হবেন, সেক্ষেত্রে আরও পাঁচজনকে সেই দল বা জোট সরাসরি সংসদ সদস্য হিসেবে মনোনীত করবে। কোনও দল বা জোট যদি ২০ ভাগ ভোট পায় তাহলে তাদের প্রাপ্ত দশজন সদস্যকে পূর্ব ঘোষিত ২৫ জনের মধ্য থেকে প্রথম দশ জনকে মনোনিত করতে হবে। শতকরা হিসেবের ভগ্নাংশের ক্ষেত্রে একটি বিধি তৈরি করতে হবে। রাজনৈতিক দল, জোট এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্য থেকে সাধারণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মোট দুশোজন প্রার্থী নির্বাচিত হবেন। অবশিষ্ট ১০০ জন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে। যেমন আইনজীবীদের প্রতিনিধি, বিচারকদের প্রতিনিধি, সাবেক সংসদ সদস্য (যারা বর্তমানে কোনও দলভুক্ত নন), অধ্যাপকদের প্রতিনিধি, সরকারি কর্মকার্তাদের প্রতিনিধি, সামরিক কর্মকর্তাদের প্রতিনিধি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিনিধি, চিকিৎসকদের প্রতিনিধি, শিল্পী-সাহত্যিকদের প্রতিনিধি, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের প্রতিনিধি, দার্শনিকদের প্রতিনিধি, শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধি, ইত্যাদি। স্ব স্ব পেশার মানুষেররা স্ব স্ব পেশার প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন।

দুই-একটি উদাহরণ দেয়া যাক। ধরে নেয়া যাক আইনজীবীদের প্রতিনিধি। বার কাউন্সিলের নির্বাচন যেভাবে হয়ে থাকে অনেকটা সেভাবে অথবা উচ্চ আদালত এবং নিম্ন আদালদের আইনজীবীরা আলাদা আলাদাভাবে আইনজীবীদের মধ্যে থেকে দুজন সংসদ সদস্য নির্বাচন করবেন। সামরিক, বেসামরিক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা স্ব স্ব পেশার জন্য এক বা একাধিক সংসদ সদস্য নির্বাচন করবেন। তবে কর্মরত কর্মকর্তারা ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারলেও প্রার্থী হতে পারবেন একমাত্র অবসরপ্রাপ্তরা। হতে পারে তাদের ন্যূন্যতম যোগ্যতা হতে হবে অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব, ব্রিগিডিয়ার অথবা ডিআইজি পদমর্যাদার। অথবা আরও উচ্চ পদমর্যাদার অবসরপ্রাপ্তরাই কেবল প্রার্থী হতে পারবেন। একইভাবে শুধুমাত্র অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিরা প্রার্থী হতে পারবেন কিন্তু ভোটাধিকার প্রদান করবেন অবসরপ্রাপ্ত এবং কর্মরত সকল বিচারপতিরা। বিভিন্ন পেশার প্রতিনিধিদের নির্বাচনে কারা প্রার্থী হতে পারবেন, কারা ভোট দেবার অধিকার লাভ করবেন বা কোন কোন পেশা থেকে একাধিক সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবে, তার জন্য বিধি তৈরি করাটা হবে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। তবে এখানে উল্লেখ্য যে, কোনও পেশার প্রতিনিধিত্বকারী সদস্য শুধুমাত্র তার পেশার স্বার্থ রক্ষার জন্য সংসদ সদস্য হবেন না। তার স্বার্থ হবে আপামর জনসাধারণের স্বার্থ। তিনি নির্বাচিত হয়েছেন একটি নির্দিষ্ট পেশা থেকে, এইটুকুই।

এবার আসা যাক নির্বাহী বিভাগের কাঠামো এবং এর গঠন প্রক্রিয়ায়। কোনও সংসদ সদস্যই নির্বাহী বিভাগের যাথে যুক্ত থাকতে পারবেন না। সাধারণ নির্বাচনে সংসদ সদস্যদের পাশাপাশি নির্বাহী বিভাগের জন্য থাকবে আলাদা প্রার্থী তালিকা। প্রতিটি দল বা জোট জাতীয় নির্বাচনে বিভিন্ন আসনের জন্য এবং আনুপাতিক হারের জন্য প্রার্থী দেবেন তেমনি কোনও দল বা জোট নির্বাহী বিভাগ গঠনের জন্য জনগণের রায় প্রাপ্ত হলে কারা মন্ত্রী পরিষদের সদস্য হবেন এবং মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী হবেন তার তালিকা নির্বাচনের আগেই প্রকাশ করবে। বাংলাদেশের মতো দেশে মন্ত্রী পরিষদের সদস্য হিসেবে ৫, ৭ অথবা ৯ জনই যথেধষ্ট। মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হিসেবে ৩০-৪০ জন প্রতিমন্ত্রী যথেষ্ট। যে দল বা জোট শতকরা হিসেবে সর্বাধিক ভোট পাবে সেই দল বা জোট নির্বাহী বিভগের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হবে।

বর্তমান প্রচলিত কাঠামোর থেকে প্রস্তাবিত নির্বাহী বিভাগের যে পার্থক্য থাকবে তা হলো, নির্বাহী বিভাগের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হবে মন্ত্রিপরিষদ, যার সদস্য সংখ্যা হবে ৫ থেকে ৯ জন এবং মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা কোনও মন্ত্রণালয় বা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত হবেন না। মন্ত্রণালয় বা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত হবেন প্রতিমন্ত্রীরা। প্রতিমন্ত্রীরা স্ব স্ব মন্ত্রণালয় বা বিভাগের কার্যকলাপের জন্য মন্ত্রিপরিষদের কাছে জাবাদিহি করবেন। মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা যৌথভাবে নির্বাহী বিভাগের সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন এবং মন্ত্রণালয় বা বিভাগের কাজ পর্যবেক্ষণ করবেন। কখনো কখনো যদি প্রতিমন্ত্রীরা মন্ত্রিপরিষদের সভায় উপস্থিত থাকেন তা হবে তাদের কর্মকে ব্যাখ্যা করার জন্য। মন্ত্রিপরিষদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের একমাত্র অধিকার থাকবে মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের।

মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের মধ্য থেকে কোনও একজন অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন আবার পর্যায়ক্রমে একাধিক সদস্য প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কেবিনেটের ব্যবস্থাপনায় বিশেষ ভূমিকা থাকলেও প্রধানমন্ত্রীসহ সকল সদস্য সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সমঅধিকার প্রাপ্ত হবেন। যেমন আপিল বিভাগের রায় প্রদানের ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারপতিরা সমঅধিকার ভোগ করে থাকেন, প্রধান বিচারপতি বাড়তি কোনও সুবিধা পেয়ে থাকেন না।

আবার নির্বাহী বিভাগে কোনও প্রধানমন্ত্রী নাও থাকতে পারেন। সেক্ষেত্রে কাঠামো গঠনে একই কর্মবিধি আইন ও বিচার বিভাগের ক্ষেত্রেও ভাবতে হবে। রাষ্ট্রীয় কাঠামো গঠনে যে অধিক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে তার মূলে রয়েছে, ছোট বা বড়, যে পরিসরেই হোক না কেন তা যেন কোনোভাবেই কেন্দ্রীভূত হতে না পারে। ক্ষমতার চলন এবং কেন্দ্রীভূত হবার প্রবণতা, এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ পরবর্তী কোনও লেখায় উপস্থাপন করা যাবে। এছাড়া আইন বিভাগ এবং নির্বাহী বিভাগের কর্মপরিধি, সংবিধানের মধ্য দিয়ে তা সুস্পষ্ট করা, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়— পরবর্তীতে তা উপস্থাপন করা হবে।

আমি এই লেখার শুরুতে এবং আগের পর্বেও বলেছি এবং আবারও বলছি, আমার ধারণাগুলো একান্ত ব্যক্তিগত ভাবনার প্রাথমিক প্রকাশ। যারা রাষ্ট্র নিয়ে আরও গভীরে ভাবেন তারা নিশ্চয়ই আরও গঠনমূলক এবং উত্তম ধারণা উপস্থাপন করতে পারবেন। আমি এ পর্যায়ে যা করতে চাচ্ছি তা হলো, আমাদের চিন্তার জগতে উদ্ভাবনামূলক ধারণাকে ঠাই দেয়া এবং এর চর্চা করা। এছাড়া ভাবনার প্রক্রিয়ায় এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্থানিক প্রয়োজনীয়তাকে উপলব্ধি করা। এ কাজটি করতে হবে সর্বসাধারণকেও।

লেখক: চলচ্চিত্র পরিচালক