হৃদ্য আবদুহুর প্রবন্ধ ‘যার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট’

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১২, ২০২২

আত্মার কুপ্রবৃত্তিকে পরিশুদ্ধ করাই সিয়াম সাধনার মূল উদ্দেশ্য। এটা সম্ভব হলে আত্মার ভেতর তাক্বওয়ার বীজ অঙ্কুরিত হয়। মানুষ যেন রমজান মাসের সিয়াম পালনের মধ্যদিয়ে আত্মাকে শুদ্ধ করে তুলতে পারে এজন্য সিয়াম ফরজ করা হয়েছে। রোজা থাকা অবস্থায় কিছু কাজ করা ও কিছু কাজ না-করার জন্য আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন। আমরা কেবল রোজা থাকা অবস্থাতেই তা মেনে চলি। এরপর রমজান মাস শেষ হয়ে গেলে সব ভুলে যাই। এটা সিয়াম সাধনার উদ্দেশ্য নয়। মনে রাখা দরকার, সিয়াম সাধনা মুত্তাকি হওয়ার ট্রেনিং। ট্রেনিং নেয়ার সময়টাতেই শুধু বিশেষ কিছু নিয়ম পালন করব, আর ট্রেনিং শেষে সব ভুলে যাব, এমনটা হলে ট্রেনিং নেয়ার কোনো দরকার পড়ে না।

তোমরা ওই নারীর মতো হয়ো না যে তার সুতো দৃঢ় করে পাকানোর পর যে সেই সুতো টুকরো টুকরো করে খুলে ফেলল। সূরা নাহল ৯২।
পুরো রমজান মাস সিয়াম সাধনার মধ্যদিয়ে মানুষ একটু একটু করে আত্মাকে শুদ্ধ করে তুলল। এরপর রমজান শেষ হয়ে গেলে আত্মাকে আবার কলুষিত করে তুলতে লাগল। এরকম হলে সিয়ামের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়। যে কোনো প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য হচ্ছে, প্রশিক্ষণ শেষেও যেন প্রশিক্ষণের শিক্ষাগুলো জীবনযাপনে কাজে লাগানো হয়। সিয়াম সাধনার প্রশিক্ষণ আমরা আমাদের জীবনে কতটা কাজে লাগাতে পারছি, সে প্রশ্ন নিজেকে একবার জিগেশ করুন।

জীবনযাপনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, সব মাসে, সবসময় ও সব অবস্থাতেই কোরআন ও হাদিসের বিধান পালন করা আল্লাহ ফরজ করেছেন। পাশাপাশি কুপ্রবৃত্তির আনুগত্যকে হারাম করেছেন। আল্লাহ ও আখিরাতকে যে বিশ্বাস করে, যে চির শান্তিময় জান্নাতের আশা করে এবং চির অশান্তির জাহান্নাম থেকে বাঁচতে চায়, তার উচিত আল্লাহর নির্দেশ মান্য করা। আল্লাহ যা ফরজ করেছেন তা পালন করা আর যা হারাম করেছেন তা ত্যাগ করা। সূরা আনফালের ২০-২১ আয়াতে আল্লাহ বলছেন, হে মুমিনরা, আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত্য করো। যখন তার কথা তোমরা শুনছ তখন তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিও না। তোমরা তাদের মতো হয়ো না যারা বলে, আমরা শুনলাম। আসলে তারা শোনে না।

প্রতিটি মানুষের উচিত, আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত্য করা এবং আল্লাহর আদেশ পালনে দৃঢ় থাকা। যারা তা করবে তাদের জন্য রয়েছে পৃথিবী ও আখিরাতের সফলতা। আল্লাহ বলেন, যারা বলে, আমাদের প্রতিপালক একমাত্র আল্লাহ, এরপর এ স্বীকৃতির ওপর দৃঢ় থাকে, তাদের কাছে ফেরেশতারা অবতীর্ণ হয় এবং বলে, তোমরা ভীত হয়ো না। চিন্তিতও হয়ো না। তোমাদেরকে যে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে তার জন্য আনন্দিত হও। পৃথিবী ও আখিরাতে আমরাই তোমাদের বন্ধু। তোমরা যা কামনা করবে তা জান্নাতে রয়েছে। ক্ষমাশীল ও অতি দয়ালু আল্লাহর পক্ষ থেকে এটা আপ্যায়ন।

সূরা আহক্বাফের ১৩-১৪ আয়াতে আল্লাহ বলেন, যারা বলে, আমাদের প্রতিপালক একমাত্র আল্লাহ, এরপর এ স্বীকৃতির ওপর দৃঢ় থাকে, তাদের কোনো ভয় নেই। তারা চিন্তিতও হবে না। তারা হবে জান্নাতের অধিবাসী। সেখানে তারা চিরস্থায়ী বসবাস করবে। এটা হবে তাদের কাজের সঠিক প্রতিদান।

সুফিয়ান বিন আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, আমাকে ইসলাম সম্পর্কে এমন একটি বিষয় বলে দিন যা আপনি ছাড়া আর কারো কাছে জিগেশ করার দরকার হবে না। জবাবে তিনি বললেন, তুমি বলো আমি আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছি এবং এর ওপর দৃঢ় থাকো। (মুসলিম) মানে, যতদিন বেঁচে থাকবে এই বিশ্বাসের ওপর জীবনযাপন করবে। আল্লাহর নির্দেশ ঠিকঠাকভাবে মেনে চলবে। আল্লাহ যা নিষেধ করেছেন তা পরিহার করে চলবে।

মানুষ যতই সৎকাজ করুক না কেন, সে আল্লাহর অনুগ্রহের যথাযথ শুকরিয়া আদায় করতে পারবে না। চোখ, কান, নাক, মুখ ও বিবেকসহ যেসব নেয়ামত আল্লাহ মানুষের দেহে দান করেছেন সেসবের শুকরিয়া কোনোভাবেই আদায় করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। ফলে যে কোনো সৎকাজ করে তা নিয়ে গর্ব করার কিছুই মানুষের নেই। বরং সৎকাজ করেও এমন ধারণা থাকা উচিত যে, এটা আর এমন কী! আরও বেশি বেশি যদি সৎ কাজ করতে পারতাম।

আল্লাহর নির্দেশ তো ঠিকঠাকভাবে পালনের চেষ্টা আমরা করি। কিন্তু কেউ কি নিশ্চিত, তার আমল আল্লাহ কবুল করেছেন? এটা কেউ কখনো নিশ্চিত হতে পারে না। সুতরাং, সৎকাজের পর তা নিয়ে গর্ব করার সুযোগ এখানে কোথায়? বরং প্রতিটি সৎকাজের পর ভীতি জেগে ওঠে যে, পরিপূর্ণভাবে হয়তো আল্লাহর নির্দেশ পালন করতে পারলাম না। এই ভীতি বিশ^াসীদের একটি বৈশিষ্ট্য। সূরা মুমিনুনের ৬০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, তাদের প্রতিপালকের কাছে তারা ফিরবে এই বিশ্বাসে যে, তারা যা দান করার তা ভীত-কম্পিত হৃদয়ে দান করে।

আয়েশা (রা.) মহনবিকে জিগেশ করলেন, হে আল্লাহর রাসুল, এ আয়াতে যাদের কথা বলা হয়েছে তারা কি চুরি করেছে? ব্যভিচার করেছে? মদ পান করেছে? জবাবে মহানবি বলেন, না, এরা তারা নয়। এরা হচ্ছে ওইসব মানুষ যারা নামাজ পড়েছে, রোজা রেখেছে, দান-সদকা করেছে। পাশাপাশি এই ভয়ে ভীত ছিল যে, যদি তাদের এসব ইবাদত আল্লাহ কবুল না করেন!

শুধু ভয় করাই নয়, একই সাথে সৎকাজ কবুল হওয়ার আশাও বুকের ভেতর জাগ্রত রাখতে হবে। আল্লাহকে ডাকতে হবে ভয় ও আশা নিয়ে। আশা ছাড়া আল্লাহর ইবাদত করার কোনো মানে হয় না। এটা পুরোপুরি নৈরাশ্যবাদ। আবার, ভয় ছাড়া শুধু আশা নিয়ে আল্লাহর ইবাদত করার মানে, আল্লাহর শাস্তি থেকে নিজেকে নিরাপদ মনে করা। সুতরাং, ভয় ও আশা ছাড়া আল্লাহর ইবাদত করা মুমিনের জন্য নিন্দনীয়। হযরত ইবরাহিম (আ.) যখন পুত্র ইসমাঈলকে (আ.) সাথে নিয়ে কাবাঘর নির্মাণ করলেন তখন তিনি আল্লাহর কাছে তাদের কাজকে কবুল করার জন্য প্রার্থনা করেন। সূরা বাকারার ১২৭ আয়াতে আল্লাহ বলেন, স্মরণ করো, যখন ইবরাহিম ও ইসমাঈল কাবাঘরের দেয়াল তুলছিল তখন তারা বলছিল, হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদের এ কাজ আমাদের পক্ষ থেকে কবুল করুন। নিশ্চয়ই আপনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ।

কোরআন ও হাদিসের বিধান অনুযায়ী জীবনযাপন করতে মানুষ যতই চেষ্টা করুক, সে চেষ্টায় কিছু ভুল থেকেই যাবে। এজন্য আল্লাহর কাছে বেশি বেশি ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। আল্লাহ বলেন, স্মরণ করো, যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসবে তখন তুমি মানুষদের দেখবে, তারা দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করছে। অতএব, তুমি তোমার প্রতিপালকের প্রশংসাসূচক তাসবিহ পাঠক করো এবং তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই তিনি সবচে বেশি তওবা কবুলকারী।
এ সূরা অবর্তীণ হওয়ার পর মহানবি প্রতিটি নামাজের রুকু ও সিজদায় পড়তেন, সুবহান আল্লাহি ওয়াবি হামদিহি সুবহান আল্লাহিল আজিম।

হে আদম সন্তান, যতক্ষণ তুমি আমার কাছে আশা করতে থাকবে ও আমাকে ডাকতে থাকবে, ততক্ষণ আমি তোমাকে ক্ষমা করে দেব। এতে আমি কারো পরোয়া করি না। হে আদম সন্তান, তোমার পাপ যদি আকাশ পর্যন্তও পৌঁছে যায় এরপর তুমি আমার কাছে ক্ষমা চাও, তাহলেও আমি তোমাকে ক্ষমা করে দেব। হে আদম সন্তান, তুমি যদি পৃথিবীসমান পাপ নিয়ে আমার কাছে হাজির হও, এ অবস্থায় যে, তুমি আমার সাথে কাউকে শরিক করোনি, আমি সমান পরিমাণ ক্ষমা নিয়ে তোমার কাছে উপস্থিত হবো। (তিরমিজি শরিফ)

সৎকাজ ফলন্ত গাছের মতো। ঠিকঠাক পানিসেচ ও রক্ষণাবেক্ষণে চারাগাছ থেকে ধীরে ধীরে বড় হয়ে গাছটিতে ফল ধরে। একইভাবে সৎকাজ কবুল হওয়ার আলামত হচ্ছে, আরও বেশি বেশি সৎকাজ করা। আগের সৎকাজ কবুল হওয়ার জন্য পরের সৎকাজগুলোয় আরও বেশি একনিষ্ঠ হওয়া জরুরি।

ফরজ আমল থেকে আরকোনো প্রিয় আমল দিয়ে বান্দা আমার কাছাকাছি আসতে পারে না। এরপর নফল ইবাদত দিয়ে বান্দা আমার আরও কাছাকাছি আসে। অবশেষে আমি তাকে ভালোবেসে ফেলি। আর আমি যখন তাকে ভালোবেসে ফেলি তখন আমি তার কান হয়ে যাই, যা দিয়ে সে শোনে। আমি তার চোখ হয়ে যাই, যা দিয়ে সে দ্যাখে। আমি তার হাত হয়ে হয়ে যাই, যা দিয়ে সে ধরে এবং তার পা হয়ে যাই, যা দিয়ে সে হাঁটে। আমার কাছে সে যদি প্রার্থনা করে তাহলে অবশ্যই তাকে দান করব। আর সে যদি আমার কাছে আশ্রয় চায় তাহলে অবশ্যই তাকে আশ্রয় দেব। (বোখারি শরিফ)

আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুল (স.) যে আমলই করতেন তা সবসময় করতেন এবং তার ওপর দৃঢ় থাকতেন। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, আল্লাহর কাছে সবচে প্রিয় আমল হচ্ছে, যে আমল সবসময় করা হয়। যদিও তা কম হোক। প্রতিপালকের আনুগত্যে সবসময় যদি আমরা সচেতন থাকি তাহলে আমাদের ভেতর একরকম আধ্যাত্মিক শক্তি তৈরি হবে। এ শক্তি আল্লাহর প্রতি আমাদেরকে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করতে বিশেষভাবে সহায়ক হবে। এ পর্যায়ে যদি কেউ পৌঁছতে পারে তাহলে তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট হয়ে যান। আল্লাহ বলেন, আল্লাহর ওপর যে নির্ভর করে তার জন্য আল্লাহ যথেষ্ট হয়ে যান। এই মহাবিশ্বের সর্বময় কতৃর্ত যার হাতে সেই আল্লাহ যার জন্য যথেষ্ট হয়ে যান, তার পাওয়ার আর কী বাকি থাকতে পারে!