
হৃদয় ছোঁয়ার দিন
উপন্যাস ১
সাজ্জাদ হায়দারপ্রকাশিত : ডিসেম্বর ২৭, ২০১৯
ঢাকা শহর এখনো সকালের শীতের চাদরে মোড়া, এই সকালেই এফডিসি জমজমাট। চারদিকে সাজ সাজ রব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হলিউডের নায়ক মার্লন ব্রান্ডো এখন ঢাকায়। ইউনিসেফের প্রচার মিশনে জাতিসংঘের প্রতিনিধি হিসাবে তার এই আগমন। কয়েকদিন ধরেই ব্রান্ডোকে নিয়ে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হচ্ছে।
মার্লন ব্রান্ডো পাকিস্তানের প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকায় আসবেন অথচ এফডিসিতে আসবেন না, তা হয় না। হোক না এফডিসি ছোট, তবু তো এটাই পাকিস্তানের হলিউড। পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে পূর্ব-পাকিস্তানের চলচ্চিত্র অনেক উন্নত, বাজারও বড়। সব রেটিংয়ে ঢাকাই এগিয়ে। কয়েকদিন ধরে পত্র-পত্রিকায় এ ধরনের বির্তক চলছে। অবশেষে সব আশঙ্কার পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে ব্রান্ডো তার কর্মসুতি এফডিসি পরিদর্শন অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
পর্দা-কাঁপানো এই নায়ককে নিয়ে সারা বিশ্বেই মাতামাতি। ইনি এখন বিশ্ব সেরা সুন্দরী এলিজাবেথ টেলরসহ অন্যান্য হলিউডি নায়িকাদের সাথে দহরম-মহরম করে কাটান। ব্রান্ডোর আগমনকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকদিন ধরেই এফডিসিতে নানা তোড়জোড় চলছে। আমান যখন এলো তখন এফডিসির সরু পথটা কড়াকড়ির মধ্যেই লোকজনে ভর্তি হয়েছে। সবাই চায় এই পর্দা কাঁপানো নায়ককে দেখে নয়ন সার্থক করতে।
এদেশে চলচ্চিত্রই এখন সবচেয়ে বড় বিনোদন। মানুষের কাছে এফডিসির নায়ক-নায়িকা, অভিনেতা-অভিনেত্রীরাই অচিন দেশের স্বপ্নের মানুষ। ব্রান্ডো সুদূরের অচিনদেশ হলিউড অভিনেতা। পর্দা কাঁপানো সেই নায়ক এখন রক্তমাংসে আসছেন এখানে! এ আর্কষণ কী উপেক্ষা করা যায়! আমান খোঁজ নিয়ে জানল, ব্রান্ডোর আসতে এখনো অনেক দেরি। এক কোনায় দাঁড়িয়ে আমান ভাবছে নিজের কথা। চলচ্চিত্রের অমোঘ আর্কষণ আমানকে ঘরছাড়া করেছে। এখানে ঘর পালিয়েই কাজ করতে হয়। এই শিল্পের অনিশ্চয়তা এখনো কাটেনি। কোনও বাবা-মা চান না এফডিসিতে কাজ করে তার ছেলেমেয়ে উচ্ছন্নে যাক।
এখানে সবাই চলচ্চিত্রের প্রতি অসম্ভব ভালবাসা আর দরদ দিয়ে কাজ করে। অনেক সময় এই ভালবাসা পাগলামিতে পরিণত হয়। কারণ অধিকাংশই প্রাপ্তি নিয়ে ভাবে না। চলচ্চিত্র কর্মীদের এই মোহকে কাজে লাগিয়ে ফায়দা লোটার মানুষেরও এখানে অভাব নেই। সংগত কারণেই আমানের বাবা চাননি আমান এফডিসিতে ঘোরাঘুরি করুক। ওদের পুকুরে মাছ, গোলায় ধান আছে। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে চাইলে বড়জোর কোনও সরকারি চাকরি করা যেতে পারে।
ছেলে সিনেমার লাইনে আছে, এটা কি পরিচয় দেবার মতো কোনও পেশা! এই সব বাধা উপেক্ষা করেই, আমানের ফিল্মি স্বপ্নের টানে বরিশাল থেকে আসা। তারপর দুবছর ধরে টিকে থাকার স্ট্রাগল। কত ধরনের স্ট্রাগলই না আছে পৃথিবীতে। আমানেরটা এক ধরনের আর ছটটুর আরেক ধরনের। ছটটু ক্লাস স্ট্রাগল নিয়ে ব্যস্ত। আর আমানের লড়াই ক্লাস স্ট্রাগল নয়, নিছক নিজের বেঁচে থাকার লড়াই। তবে স্ট্রাগল ছাড়া বিকশিত হওয়া যায় না, মার্কসের এই কথাটা আমান প্রাণপণে বিশ্বাস করে। নয়তো অনেক আগেই এখান থেকে বিদায় নিতে হতো। ফিকে হয়ে এলেও আমানের ফিল্মি স্বপ্ন এখনো মিলিয়ে যায়নি। বেঁচে থাকার জন্য, কাজের জন্য, এ স্বপ্ন এখনো টনিকের মতো কাজ করে।
মালিবাগের এক মেসবাড়িতে মুলিবাঁশের বেড়ার ফাঁক দিয়ে আসা তীব্র রোদের আঁচে প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙে। তারপর আলুভর্তা, নয়তো ডাল দিয়ে ভাত খেয়ে স্টেট বাসে ঝুলে এফডিসিতে আসতে হয়। কাজ শেষে গভীর রাতে বাড়ি ফিরে একরাশ ক্লান্তি আর নিভু নিভু স্বপ্ন নিয়ে প্রতিদিন ঘুমিয়ে যায়। এভাবে দিনগুলো দ্রুত চলে যাচ্ছে। প্রায় পেটে ভাতে হলেও কাজের অভাব এফডিসিতে নেই। একেবারে বিনা পয়সায় কাজ করিয়ে নেয়ার লোকেরও অভাব নেই।
বিচিত্র আর অভিনব সব কাজ, জুতা সেলাই থেকে চণ্ডিপাঠ। ডায়লগ বলা, ক্লাপস্টিক ধরা, কস্টিউমের কন্টিনিউটি রাখা। কখনো কখনো নায়িকার জুতো এগিয়ে দেয়া। এসব কাজের গালভরা নাম ’অ্যাসিটেন্ট ডাইরেক্টর’। কাজ যাই হোক, এ পদবির কিছু সুবিধাও আছে। দূরের মানুষের কাছে নানা সুবিধা পাওয়া যায়। মেসের বাড়িঅলা কিংবা মুদির দোকানি ওকে আলাদা সম্মান করে। জমে থাকা বকেয়া টাকার জন্য তেমন তাগাদা করে না। শুনতে চায় রাজ্জাক-কবরী কিংবা আজিম-সুজাতার গল্প। কবরী, সুজাতা সত্যি ভাত খায় কিনা সেই প্রশ্নও ওরা মাঝে মাঝে করে। আরেকজন জিজ্ঞাস করে টিকেট কেটে পয়সা দিয়ে রাজ্জাক-কবরীকে দেখা সম্ভব কিনা।
চব্বিশ বছরের এ জীবন কম হতাশার না। মাঝে মাঝে অনিশ্চিত হয়ে যায় সব কিছু। এলোমেলো লাগে সবকিছু। খুব হতাশ হলে আমান মনে মনে ওর চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য সাজায়। নিজের স্বপ্নটা সজীব রাখতে চেষ্টা করে। তারপরও হতাশা কমে না। নিজের একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের লালিত স্বপ্ন এ জীবনে বোধ হয় পূরণ হবার নয়! মূর্তিমান শফিভাই এ আতংক বাড়িয়ে দেন। একিরা কুরুশোয়া, সত্যজিৎ রায়, ডিসিকা, নিউ ওয়েভ এই সব শব্দ বাতাসে ভাসিয়ে শফি ভাই এখনো নিজের স্বপ্ন চাঙা রাখতে চান। শফি ভাইয়ের স্বপ্ন স্বপ্নই থাকে! তবু অদম্য শফি ভাই এফডিসিতে এসে কিংর্ষ্টোক সিগারেট আর কয়েক কাপ চা পান করে দিন পাড় করে দেন। বিখ্যাত ঝোলায় থাকে বিভিন্ন দেশের সিনে জর্নাল আর পরম যত্নে কাগজে মোড়ানো বাঙলা মদের একটি বোতল।
তিনি প্রতিদিনই তার ’বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র’ নির্মাণের জন্য প্রযোজক শিকারে এফডিতে বসে থাকেন। কিন্তু তাকে দেখলেই প্রযোজকদের ব্যস্ততা বাড়ে, শফিভাইকে এড়িয়ে চলেন। সেদিন বক্স অফিস খ্যাত এক পরিচালককে পাকড়াও করে শফি ভাই বললেন, ও মশাই মন্তাজ কি?
সে কৈফিয়ত কি আপনাকে দিতে হবে? তেড়িয়া হলেন পরিচালক।
হো হো করে হেসে উঠলেন শফি ভাই, শ্লেষের হাসি। পরিচালক এবার আস্তিন গুটিয়ে মারতে এলেন। ঠিক এসময় ত্রাণর্কতার মতো ছুটে এলেন খান আতা। চীনের প্রাচিরের মতো দাঁড়ালেন দুজনের মাঝখানে। শফিভাই এ যাত্রা বেঁচে গেলেন। খান আতা বরাবরই শফি ভাইকে প্রশ্রয় দেন। আজ ব্রান্ডো আগমনে নিশ্চয়ই শফি ভাই আসবেন। ব্রান্ডোর যাবতীয় তথ্য নিশ্চয়ই এরই মধ্যে শফি ভাইয়ের কাছে জমেছে। ব্রান্ডোর সেরা কাজ কিংবা এখন ব্রান্ডো কার সাথে রাত কাটান অথবা ব্রান্ডোর সাথে গেগ্ররী পেক কিংবা রির্চাড বাটনের পার্থক্য ইত্যাদি সব নিশ্চয়ই তার নখদর্পনে।
আমান দেখল, খোলা চত্বরের এক কোনায় রাজ্জাক-কবরী দাঁড়িয়ে। ব্রান্ডোর জন্য অপেক্ষমান। ওদের মধ্যে তুমুল আড্ডা জমে উঠেছে। ওদের দিকে নজর বুলিয়ে আমান চায়ের দোকানের দিকে হাঁটা দিল। আজ সকালে চা খাওয়া হয়নি। চায়ের স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছেন জামান ভাই। তিনি চিত্রনাট্য লেখেন। অসাধারণ ক্যামেরাম্যান, সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখেন। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে চলচ্চিত্রের প্রতি জামান ভাইয়ের আগ্রহ। জামান ভাই বিশ্বাস করেন, ক্যামেরা দিয়েও বিপ্লব করা যায়। জামান ভাই আলমগীর কবিরের সাথে চলচ্চিত্র আন্দোলনে যুক্ত। আমানের সাথে জামান ভাইয়ের বন্ধুর মতো সর্ম্পক। আমানকে জুনিয়র মনে করে তাচ্ছিল্য করেন না।
চায়ের কাপ হাতে আমানকে দেখে এক কদম এগিয়ে এলেন। এই যে আমান, ঘটনা শুনেছ? ব্রান্ডোকে নাকি পাওয়া যাচ্ছে না!
সেকি জামান ভাই!
বড়কর্তা ব্রান্ডোকে নিয়ে আসার জন্য গাড়ি হাঁকিয়ে নিজেই ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে গিয়েছিলেন। ব্রান্ডো লাপাত্তা। এখন বোঝো অবস্থা! নয়টার প্রোগ্রাম, এগারটা বাজতে চলল।
চায়ের কাপ হাতে নিয়ে একথা-সেকথার পর দুজনের মধ্যে তুমুল আড্ডা জমে উঠল। হঠাৎ চারদিকে একটা হইচই উঠল। এফডিসির মাইক সরব হলো। ব্রান্ডোকে পাওয়া গেছে। বিপুল বেগে সবাই ছুটল গেটের দিকে। না কোনও গাড়ি নয়, ব্রান্ডো আসছেন রিকশায় চড়ে। হাতে মেলে ধরেছেন ইউনিসেফের একটা পোস্টার। রিকশা চালক নির্বিকার ভঙ্গিতে গেটের কাছাকাছি আসতেই জনতা যেন আছড়ে পড়ল রিকশার ওপর। জামান ভাইয়ের সাথে একটা ইটের স্তূপে দাঁড়িয়ে পুরো ঘটনা উপভোগ করল আমান। ব্রান্ডোর সাথে সাথে পুরো জনতা প্যান্ডেল মুখি হলো।
ও হা, আরেকটা কথা। শফি হাসপাতালে।
বলেন কি?
পাবনা মেন্টাল হাসপাতালে।
মাইকের শব্দে জামান ভাইর কথা চাপা পড়ে যায়। জামান ভাই অন্য দিকে হাঁটতে থাকেন। সিআইএ’র এজেন্ট মার্কিন অভিনেতার ব্যাপারে তার কোনও আগ্রহ নেই।
আমানের চোখ জ্বালা করে-আউট অফ ফোকাস হয় ব্রান্ডো এপিসোড। শফিভাই অনেক স্বপ্ন দেখতেন। চলচ্চিত্র দিয়ে সমাজ পরিবর্তনের জন্য কিছু করতে চেয়েছিলেন। শফিভাইর চেয়ে অনেক অযোগ্য লোক আজেবাজে ছবি বানিয়ে দেশের হিরো বনে গেছেন। আর আপোষহীন থাকার পুরস্কার তিনি পেলেন, মেন্টাল হাসপাতাল। এ মুহূর্তে ছটটুকে খুব মনে পড়ছে। ছটটু ঘরছাড়া বিপ্লবী। প্রতি মুর্হূতে আশাভঙ্গের যন্ত্রণা ওকে সইতে হয় না। একদিক থেকে ছটটুই ভাল আছে। এই ঘুণে ধরা সমাজটাকে অস্বীকার করেই ছটটু বিপ্লবের স্বপ্ন দেখে। চলতি সমাজের কাছে ওর চাওয়া-পাওয়া নেই। আর আমানকে এই সমাজেই থাকতে হয়। এ সমাজ আমানের মতো স্বপ্নভূক তরুণদের প্রতিপদে প্রতারিত করে। শফিভাই তার প্রমাণ। ছটটু এই সমাজটা ভাঙতে চায়। ছটটু এ সমাজটা ভাঙতে পারলেই আমান বেঁচে যেত! চলবে