
হৃদয় ছোঁয়ার দিন
উপন্যাস ৩
সাজ্জাদ হায়দারপ্রকাশিত : ডিসেম্বর ২৯, ২০১৯
আইয়ুব খান ভেবেছিলেন, ভারতবিরোধী চিন্তাচেতনার প্লাবন ঘটিয়ে অনেকদিন ক্ষমতায় পাকাপোক্ত থাকবেন। জনগণের মনমানসিকতা তৈরিতে ধর্ম হবে অন্যতম উপাদান। আইয়ুব কর্তৃক নিযুক্ত গর্ভনর মোনায়েম খান ছিলেন এককাঠি বাড়া। তিনি জাতপাত নিয়ে সারাক্ষণ মাথা ঘামাতেন। পাকিস্তানের জন্ম হয়েছে মুসলমানদের জন্য। ভারতীয়দের সাথে ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক ব্যবধানই পাকিস্তানের রক্ষা কবচ। পুরো মাত্রায় তার এ বিশ্বাস ছিল। আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ সাচ্চা মুসলমান কিনা এই প্রশ্ন তুলেছিলেন। মোনায়েম খান বিষয়টা নিয়ে নিশ্চয়ই গভীর চিন্তায় পড়েছিলেন। এখানকার মানুষজন মসজিদে যায়। আবার মসজিদ থেকে এসে হিন্দু রবীন্দ্রনাথের গান শোনে। পহেলা বৈশাখে গাছতলার নিচে বসে গান করে! এ কি সাচ্চা মুসলমানের লক্ষণ? এ কারণেই বোধ হয় তিনি সাচ্চা মুসলমানদের উপযোগী শিল্প-সাহিত্য চাষাবাদে নামেন।
শোনা কথা, তিনি নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক কাম সাহিত্যিককে রবীন্দ্র সংগীত রচনার জন্য ফরমায়েস দিয়েছিলেন। এ ফরমায়েস করেই তিনি থামলেন না, গড়ে তুললেন ব্যুরো অব ন্যাশনাল রিকনসট্রাকশন (বিএনআর) নামের এক পাঠশালা। মজার ব্যাপার হলো, অনেক দিক্পাল কবি-সাহিত্যিক অচিরেই এই আয়োজনে সামিল হলেন। অনেকে আবার এখান থেকে পয়সা নিয়ে উল্টো কাজও করেছেন।
তবে পাকিস্তানি ভাবধারার উপযোগী সাহিত্যকর্ম কতটা রচিত হলো তা ঠিক বোঝা না গেলেও এই প্রতিষ্ঠান বেশ কিছু দালাল বুদ্ধিজীবি ক্রয় করতে সক্ষম হয়। গণঅভ্যুত্থানে আইয়ুর-মোনায়েমের পতন হলেও ঢাকার নিমতলীতে বিএনআর অফিসটি এখনও আগের মতো কর্মমুখর। অক্টোবর সন্ধ্যা। নিমতলীর রাস্তা দিয়ে ছটটু আনমনে হেঁটে চলেছে। রাস্তার একদিক চলে গেছে ফুলবাড়িয়ার দিকে। অন্যদিকটা মেডিকেল কলেজের দিকে। দক্ষিণ দিকে বস্তি। ঘোড়ার গাড়ির গাড়োয়ানদের বাড়িঘর। যত্রতত্র ঘোড়ার আস্তাবল। খোলা আকাশে ঘোড়ার গাড়ির গ্যারেজ। এখানকার বাতাসে ভেসে বেড়ায় গোবর-ঘোড়ার গায়ের উৎকট গন্ধ আর কাঁচা ঘাসের ঘ্রাণ। বস্তি থেকে একটা কাঁচা রাস্তা বিএনআর অফিসে বিপরীতে এসে মিশেছে। বড় রাস্তাটা নির্জন হলেও বস্তির ওই দিকটা জমজমাট।
অনেক আগেই অফিস ছুটি হয়েছে। বিএনআর অফিসের গাড়ি বারান্দায় থাকা একশো ওয়াটের বাল্ব কুয়াশা মেশানো সন্ধ্যার অন্ধকার দূর করার চেষ্টা করছে। গেটে প্রকাণ্ড তালা ঝুলছে। একপাশে গার্ড রুম। ওখানে এখন কোনও গার্ড নেই। সাত্তারের তথ্য মতে, গার্ড এখন গাঁজা সেবনের জন্য বস্তিতে বসে আছে। ছটটু দেখতে পেল, মেডিকেল কলেজের রাস্তা ধরে ব্যাগ হাতে কেউ একজন এদিক আসছে। নিশ্চয়ই সাত্তার। ছটটু সিগারেট ধরনোর ভান করে দাঁড়ালো। কোনও কথা না বলে সাত্তার হাতের ব্যাগ মেলে ধরল। ছটটু সাবধানে ব্যাগ থেকে তুলে নিল দুটি মলটভ ককটেল। ইংগিত করল সাত্তারকে দ্রুত সরে যেতে। ছটটু বিএনআর ভবনের দিকে কয়েক কদম এগিয়ে জানালা লক্ষ্য করে সর্বশক্তি দিয়ে মলটভ ককটেল ছুড়ল। শক্ ওয়েভের প্রচণ্ড ধাক্কায় ঝনঝনিয়ে ভাঙল জানালার কাচ।
নির্জন সন্ধ্যায় প্রচণ্ড শব্দে ভুমিকম্পের মতো কেঁপে উঠল গোটা এলাকা। পাশের বস্তিতে শুরু হলো শোরগোলে। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল ছটটু। সম্বিত ফিরল সাত্তারের থাক্কায়। এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে ছটটু বিস্ফোরণে ধ্বংস হওয়া কাচের টুকরা, চল্টা ওঠা দেয়াল খুটিয়ে দেখছিল। সাত্তারের ধাক্কায় মনে পড়ল সব চেয়ে কঠিন কাজ এখন বাকি। ছটটুকে পালাতে হবে। উৎসুক মানুষজন চলে এলো বোধ হয়! ছটটু ধরল পূর্ব দিকের রাস্তা। সাত্তার ছুটল পশ্চিমে। নিরাপদ দূরত্বে এসে ছটটু পেছন দিক চাইল, দূরে দেখা যাচ্ছে বিএনআর ভবন। ওখানে এখন মানুষের জটলা।
তিন মিনিটের মধ্যে গুলিস্তান এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল ছটটু। আজ রাতে দলের পক্ষে বিএনআর আফিস হামলার দায়িত্ব স্বীকার করে, ঢাকা শহরের শত শত লিফলেট বিলানো হবে। এখন এক ধরনের স্বস্তি বোধ করছে ছটটু। দুবছর আগে বরিশালে ছটটু মৌলবাদীদের মিছিলে বোমা হামলা করেছিল। ওই ঘটনায় ইয়াহিয়ার সামরিক আদালত ছটটুর অনুপস্থিতিতে ওকে সাত বছরের জেলবাসের রায় দেয়। সেই থেকে চলছে ছটটুর ফেরারি জীবন। এখন নিজেকে অনেক হালকা লাগছে। প্রথম অ্যাকশনের মতোই ছটটুর দলের দ্বিতীয় অপারেশন সফল। নিজেকে নিজেই সাবাসি দিল। চলবে