কলকাতার কত রঙ্গ এবং বাবু সংস্কৃতি

পর্ব ১২

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : জুলাই ০৬, ২০২১

কলকাতার তৎকালীন ছাপাখানার সাথে সম্পর্কিত আর একটি বিষয় হলো বটতলার সাহিত্য। বটতলার সাহিত্য কথাটা খুব অবজ্ঞাসূচক ভদ্রলোকদের কাছে। সেই বটতলার সাহিত্যও খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়া কলকাতার ইতিহাসে। সেকালের কলকাতায় একটি বিখ্যাত বটগাছ ছিল শোভাবাজারে। শোভাবাজারের বটগাছে একটি বাঁধানো চাতাল ছিল। বটতলায় কবি-গানের আসর জমতো, নিধুবাবুর টপ্পাসুরে বটতলার পারিপার্শ্ব সরগরম হয়ে উঠতো। শুধু তাই নয়, ছাপার অক্ষরে নবযুগের বাঙালির সাহিত্য-সাধনার উদ্বোধনও হয় এই বটতলার আশেপাশে। বটতলা তাই শুধু বিদ্রুপেরই বিষয় নয়, তারও একটা ইতিহাস আছে, নয়া কলকাতা সৃষ্টিতে তারও একটা বিরাট ভূমিকা রয়েছে।

ঊনিশ শতকের শুরু থেকেই বটতলার যাত্রা শুরু। আঠারশো আঠারো-আঠারশো বিশ সালের মধ্যেই বটতলার প্রথম ছাপাখানা করেন বিশ্বনাথ দেব। সতেরশো আটানব্বই সালের গোড়ার দিকে পঞ্চানন যে প্রথম বাংলা হরফ তৈরি করে তার অবস্থা বেশ করুণই ছিল। ছেনিকাটা ছাঁচেঢালা অক্ষর সাধারণত খুব সূক্ষ্ম, সুতরাং অল্পদিনের ব্যবহারেই তা ভেঙে যেতো। মুদ্রণযন্ত্র ছিল তখন কাঠের, তাও খুব নড়বড়ে। ছাপার সময় মনে হতো এই বুঝি যন্ত্রাটি খসে পড়ে। ছাপার কাগজও ছিল জীর্ণ শীর্ণ, মধ্যে মধ্যে ভাতের মার দিয়ে জোড়া দেওয়া। এ-হেন গলিতনখদন্ত কাষ্ঠযন্ত্র, ছেনিকাটা ছাঁচেঢালা হরফে, হাতে-তৈরি জীর্ণ কাগজে বটতলার বই যে এখনকার মতন ঝক্ঝকে ছাপা হতো না তাই তো ছিল স্বাভাবিক।

ছেনিকাটা ‘ভ’ অনেক সময় ‘ত’-র মতো দেখতে হতো। ‘ক’ হয়তোবা মেশিনের চাপে ভেঙে ‘ব’ হয়ে যেতো। ‘ম’ বা ‘য‘ র মধ্যে সবসময় পার্থক্য করা যেতো না। ফলে ভুল তো ছাপা হতোই এমন কি বিসদৃশ্য ছাপা হতো। বটতলার ছাপাকে লক্ষ্য করে একটা বিদ্রুপাত্মক প্রবচন তাই এককালে খুব চালু হয়েছিল তাহলো ‘শবল কাবল ভূষি ভূষি সে কাবল’। আসলে ‘সকল কারণ তুমি, তুমি সে কারণ’ ছাপাতে গিয়ে নানাকারণে এবং হরফ ভেঙেচুরে ছাপা হয়ে গেল ‘শবল কাবল ভুষি ভূষি সে কাবল’। মুদ্রণযন্ত্রে প্রথমে বই ছাপা অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার ছিল, ছাপাতে খরচ পড়তো যথেষ্ট এবং দামও ছিল বেশি। পরে বটতলার প্রকাশকদের অক্লান্ত চেষ্টায় বাংলা ছাপা বইয়ের দাম অনেক কমে যায় এবং তা বাংলার ঘরে ঘরে হাজার হাজার বাঙালি পাঠক-পাঠিকার হাতে পৌঁছয়।

মুকুন্দরামের ‘চণ্ডীমঙ্গল কাব্য’ আঠারশো তেইশ সালে বিশ্বনাথ দেবের প্রেসে যখন ছাপা হয় তখন তার দাম ছিল ছয় টাকা, পরে আঠারশো ছাপ্পান্ন সালে যখন কমলালয় প্রেসে ছাপা হয় তখন দাম রাখা হয় মাত্র এক টাকা। কৃত্তিবাসের ‘আদিপর্ব’ আঠারশো একত্রিশ সালে যখন রামকৃষ্ণ মল্লিকের প্রেসে ছাপা হয় দাম ছিল তিন টাকা, পরে আঠারশো ছাপ্পান্ন সালে যখন সুধাসিন্ধু প্রেসে ছাপা হয় দাম রাখা হলো মাত্র চার আনা। পরবর্তীকালে অন্যান্য গাছতলায় অনেকে বই ছেপে কৃতিত্ব অর্জন করেছেন, কিন্তু বটতলার প্রকাশকরাই সবার আগে সকলের পথপ্রদর্শক। বটতলার দৌলতেই বাংলা সাহিত্য প্রথম বাঙালির কাছে লোকপ্রিয় হয়ে ওঠে। যখন ঊনিশ শতকের ষাট-সত্তর দশকে মধূসূদনের কাব্য বা বঙ্কিমের উপন্যাস নিয়ে সুধীমহলে হৈচৈ হচ্ছে তখন উচ্চমার্গের সাহিত্যের চেয়ে ব্যাপক প্রচার ছিল বটতলার প্রকাশিত সস্তা পাঁচালী, ধর্মগ্রন্থ, প্রহসন; যেগুলি সহজ চলতি ভাষায় রচিত হতো এবং অল্পশিক্ষিত পাঠক-সাধারণের কাছে আদরনীয় ছিল। বঙ্গদর্শনে এইসব রচনা সম্পর্কে বঙ্কিম অভিযোগ করেছিলেন, ‘সামান্য শিক্ষার বৃদ্ধি হওয়ায়, অল্পশিক্ষিত পাঠকের শ্রেণী বাড়িয়াছে। তাহারা কি পড়িবে?... তাহাদিগের মনোরঞ্জনার্থে একশ্রেণীর লেখক উৎপন্ন হইয়াছে। তাহারাও সেই অল্প শিক্ষিত শ্রেণীর লোক; তাহাদের রুচি মার্জিত ও পরিশুদ্ধ হয় নাই; সুতরাং অশ্লীলতা ও কদর্য্যতাপ্রিয় লেকক-পাঠক উভয়ই এক শ্রেণীর লোক।’

নিশ্চয় এটা বঙ্কিমের মতো ইংরেজী শিক্ষিত আমলা এবং সমাজ-বিচ্ছিন্ন মানুষের অভিযোগ। কিন্তু যুগের বাস্তবতা ভুললে চলবে কী করে। বটতলার সাহিত্যে মূলত বাবুদের নানা কর্মকাণ্ডকে ব্যঙ্গ করা হতো। বাবুদের নানা কেচ্ছা কাহিনী স্থান পেতো। বিদ্যাসুন্দর পালায় তো ধর্মীয় দেব-দেবীদের মানুষের স্তরে নামিয়ে আনা হয়েছিল। বটতলার ছাপাখানা থেকে প্রকাশিত গ্রন্থ সম্পর্কে নানা-ধরনের অশ্লীলতার প্রশ্ন উঠেছিল। দু-একজন ইংরেজদের পক্ষ থেকে সেগুলো নিষিদ্ধ করতে ভদ্রলোকদের উস্কানো হয়। ভদ্রলোকদের ব্যাপক প্রচার অভিযানের চাপে কলকাতার পুলিশ বটতলার কিছু প্রকাশককে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়; ভারতচন্দ্র’ ও ‘বিদ্যাসুন্দর’ ছাপানো ও বিক্রির অভিযোগে। রুচিবান সমালোচকরা বলেন, বিকৃতরুচি বটতলার সাহিত্যিকরা ও প্রকাশকরা নাকি ব্যাঙের ছাতার মতন গজিয়ে উঠেছিলেন। বিনয় ঘোষ মন্তব্য করছেন, হয়তো তাই হয়েছিল, কিন্তু ব্যাঙের ছাতাও তো যত্রতত্র গজিয়ে ওঠে না। গজাবার মতো আবহাওয়া থাকা চাই। বটতলার সাহিত্য একটা মরসুমী ফুল এবং সেটা কলকাতা শহরের বিকৃত বাবু সংস্কৃতির মরসুম। বাবুরা সেখানে টাকার দাপটে একধরনের বিকৃতির জন্ম দিয়েছেন আার সাধারণ মানুষরা তাঁদের দারিদ্র এবং কমরুচি এবং সামান্য শিক্ষা নিয়ে ভিন্ন সংস্কৃতিকে লালন করেছেন।

কলকাতার সংস্কৃতি, তার সমাজবিজ্ঞান, বিবর্তন বুঝতে হলে সেই সংস্কৃতি বা কলা-সাহিত্যের গুরুত্ব কম নয়। শুধু ভদ্রলোকের সাহিত্য বা শিল্পকলা দিয়ে মূল সত্য জানা যাবে না, বটতলার সাহিত্য এবং নিম্নবর্গের শিল্পকলাকেও অনুধাবন করতে হবে। নিম্নবর্গের সাহিত্য ও শিল্পকলাকে অনুধাবন না করলে শুধু বাবুরাই সকল ঘটনার নায়ক বলে মনে হবে এবং নিম্নবর্গকে সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে বাবুরাই শুধু প্রতিষ্ঠা পাবে। বাংলার বটতলার সাহিত্যের বিরাট সংখ্যক পাঠক ছিল। নিশ্চয় সে-সব পাঠকরা নিরক্ষর ছিল না। বাংলার পাঠশালা শিক্ষার মাধ্যমেই যে তাদের সাক্ষরতা সম্পন্ন হয়েছিল সে-কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। দরিদ্র এসব মানুষের ভদ্রলোকদের বিদ্যালয়ে পড়বার সুযোগ ঘটেনি। যাঁরা বটতলার লেখক ছিলেন, পাঠশালা থেকেই তাঁরা লিখবার মতো বিদ্যা অর্জন করেছিলেন। শুধু কলকাতা শহরে নয়, কলকাতার বাইরেও, বিশেষ করে ঢাকা শহরের চকবাজার থেকেও বটতলার মতো চটি বহুগ্রন্থ বের হয়েছিল। পাঠক মহলে বটতলার সাহিত্যের চাহিদা এতো বেশি ছিল যে, কোনো কোনো বই ত্রিশ হাজার সংখ্যা পর্যন্ত ছাপতে হয়েছে। বটতলার এক ব্যাপক পাঠক সমাজ সারা বাংলা জুড়ে ছড়িয়েছিল। নিম্ন মধ্যবিত্ত, দরিদ্র, অল্প-শিক্ষিত ও স্বল্প অক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন হিন্দু-মুসলমানরা মূলত ছিল এই পাঠক সমাজের অর্ন্তভুক্ত। সুলভ মুদ্রণযন্ত্র, সহজবোধ্য বাংলা ও বিপুল সংখ্যক পাঠকÑএই তিনটি ছিল বটতলা সাহিত্যের রমরমার কারণ। চলবে