ড. আহমাদ রাইসুনির প্রবন্ধ ‘কাউকে শহিদ বলা যাবে কিনা’

অনুবাদ: এনামুল হাসান আজহারি

প্রকাশিত : অক্টোবর ২৯, ২০২১

আমি সামসময়িক কোনো কোনো শাইখের লেখা এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচারিত তাদের আলোচনা থেকে জানতে পারলাম, তারা জিহাদের ময়দান বা যুদ্ধক্ষেত্রে কিংবা আল্লাহর পথে দাওয়াত দিতে গিয়ে অথবা ইসলামের কাজ করতে গিয়ে নিহত হওয়াদের শহিদ বলা নিয়ে আপত্তি করছেন। যেমন তাদের অনেকে বলছেন, যদি আমরা কিছু লোককে এ দাবিসহ যুদ্ধ করতে দেখি যে, ‘আমরা ইসলামের জন্য, ইসলামের প্রতিরক্ষায় যুদ্ধ করছি।’ আর সে যুদ্ধে তাদের কেউ মৃত্যুবরণ করল, এমতাবস্থায় আমরা কি তাকে শহিদ বলে গণ্য করব? তাদের উত্তর হলো, না, আমরা তাকে শহিদ হিসেবে গণ্য করব না। তারা বলেন, এটা হারাম, সুতরাং যাকে ইচ্ছা তাকে শহিদ হিসেবে গণ্য করা জায়েয নয়।

নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তিকে শহিদ আখ্যায়িত করার বিপক্ষে তারা যে দলিলগুলো শুরুতেই পেশ করে থাকেন তা হলো, ইমাম বুখারিকর্তৃক তাঁর হাদিসগ্রন্থে সংযোজিত একটি অধ্যায়ের শিরোনাম, ‘অমুক শহিদ, এটা না বলার অধ্যায়।’ সে অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে, আবু হুরায়রা রা. রাসূলুল্লাহ সা. থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, আল্লাহর রাস্তায় কে জিহাদ করে এবং তাঁর রাস্তায় কে নির্যাতিত হয় সে সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালাই ভালো জানেন।

এছাড়া উক্ত অধ্যায়ে আরেকটি দীর্ঘ হাদিস রয়েছে, যার উদ্দিষ্ট হুকুম ধারণকারী অংশ হাদিসের শেষে উল্লিখিত হয়েছে। তা হলো, মানুষের চোখে অনেক ব্যক্তির কাজ জান্নাতিদের মতো, অথচ সে জাহান্নামি। আবার অনেকের কাজ দেখতে জাহান্নামিদের মতো, অথচ সে জান্নাতি। এমনিভাবে ইমাম মুসলিমসহ অন্যান্যদের সূত্রে উমর ইবনুল খাত্তাব রা. থেকে বর্ণিত একটি হাদিস থেকে তারা দলিল পেশ করেন। উমর রা. বলেন, খাইবারের যুদ্ধের দিন কতিপয় সাহাবি আগমন করলেন এবং বলতে লাগলেন, অমুক শহিদ, অমুক শহিদ। তারা একটি লাশের পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় বলছিলেন, অমুক শহিদ। তখন রাসূল সা. বললেন, কখখনো নয়! আমি তাকে জাহান্নামে জুব্বা পরা অবস্থায় দেখেছি, যা সে গণিমতের মাল থেকে আত্মসাৎ করেছে।

তারা উমর রা.-এর একই অর্থবোধক অন্য আরও একটি উক্তি দ্বারা দলিল পেশ করেন। তাদের এই মত ও মতের ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত উপলব্ধির প্রত্যুত্তর দেয়ার পূর্বে সর্বসম্মতভাবে স্বীকৃত একটি বিষয়ের আলোকপাত করা প্রয়োজন, যাতে কোনো ধরনের বিতর্ক ও সংশয়ের অবকাশ না থাকে। তা হলো, আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রত্যেক ব্যক্তির অবস্থান, হাকিকত এবং আখিরাতে তার সর্বশেষ ঠিকানা একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই জানেন। এ বিষয়ে অন্য কেউ নিশ্চিত করে কিছুই জানে না। একমাত্র তিনিই জানেন কে প্রকৃত মুমিন, আর কে প্রকৃত শহিদ। কে সৌভাগ্যবান, কে জান্নাতি? আর কে জাহান্নামি, কাকে ক্ষমা করা হবে আর কাকে ক্ষমা করা হবে না? এমনকি নবিদেরও এই বিষয়ে কোনো জ্ঞান নেই, তবে যাদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা ওহির মাধ্যমে তাদের জানিয়েছেন; তারা ভিন্ন ।
তা
র মানে এই নয় যে, কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে অথবা নির্দিষ্ট কোনো শ্রেণির মানুষকে শহিদ বলা যাবে না। বরং শহিদ আখ্যা দেয়া সাধারণভাবে ইসলামি শরিয়াহ এবং বিশেষ করে সুন্নাতে নববির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। নিম্নে তার বর্ণনা দলিলসহ উপস্থাপন করা হলো:

ওপরে উল্লেখিত উমর রা. থেকে বর্ণিত সহিহ মুসলিমের হাদিস, যাতে উল্লেখ রয়েছে, কতিপয় সাহাবি আগমন করলেন এবং বলতে লাগলেন, অমুক শহিদ, অমুক শহিদ। তারা একটি লাশের পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় বলছিলেন, অমুক শহিদ। তখন রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, কক্ষনো নয়! আমি তাকে জাহান্নামে জুব্বা পরা অবস্থায় দেখেছি। যা সে গণিমতের মাল থেকে আত্মসাৎ করেছে।

এ হাদিসে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, সাহাবায়ে কেরাম খাইবারের যুদ্ধে শহিদদের নির্দিষ্ট করে নাম ধরে ধরে বলছেন, অমুক শহিদ, অমুক শহিদ, অমুক...। শুধু একজন ছাড়া অন্য কারও ব্যাপারে রাসূল সা. আপত্তি করেননি। আর যুদ্ধে মৃত্যুবরণকারী সাহাবিদের শহিদ হিসেবে ব্যক্ত করা ছিল, তাদের অবস্থা ও বাহ্যিক কর্মের ওপর নির্ভর করে। অর্থাৎ রাসূল সা.-এর উপস্থিতিতে সাহাবায়ে কেরাম নির্দিষ্ট কিছু লোককে শহিদ আখ্যায়িত করেছিলেন। কিন্তু তিনি দ্বিমত পোষণ করেননি; বরং চুপ থেকে তার স্বীকৃতি দিয়েছেন। সুতরাং তা সুন্নাতে তাকরিরিয়্যাহ বা মৌনসম্মতির অন্তর্ভুক্ত। আর শুধু নির্দিষ্ট একজন ব্যক্তির ক্ষেত্রে তিনি দ্বিমত পোষণ করেছেন। কারণ, তার খবর আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে ওহির মাধ্যমে রাসূল সা.-কে জানানো হয়েছে।

ইমাম বুখারি রহ. তাঁর সহিহ বুখারিতে উদ্ধৃত করেন, হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ আল আনসারি রা. থেকে বর্ণিত, তাঁর পিতা উহুদের দিন শহিদ হন। তিনি ছয়জন কন্যা সন্তান রেখে যান এবং তাঁর কিছু ঋণ ছিল। অতঃপর যখন খেজুর কর্তনের মৌসুম এলো, আমি রাসূলুল্লাহ সা.-এর কাছে এলাম এবং বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি অবশ্যই জানেন যে, আমার পিতা উহুদের দিন শাহাদাত বরণ করেছেন...।

উক্ত হাদিসে সাহাবি জাবির রা. তাঁর পিতা আবদুল্লাহ আল আনসারি রা.-কে শহিদ হিসেবে ব্যক্ত করেছেন এবং তাতে রাসূল সা.-এর স্বীকৃতিও স্পষ্ট। সুতরাং তা সুন্নাতে তকরিরিয়্যাহ বা মৌনসম্মতি।

সাহাবি, তাবিয়ি, তাবে-তাবিয়িদের যুগসহ পরবর্তী সময়ে আল্লাহর পথে মৃত্যুবরণকারীদের শহিদ আখ্যা দেওয়ার ব্যাপক প্রচলন পাওয়া যায়। যেমন হযরত আম্মার ইবনে রা.-এর মাতা সুমাইয়া রা., যাকে সর্বদা ইসলামের প্রথম শহিদ বলা হয়ে থাকে। মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা গ্রন্থে হযরত মুজাহিদ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ইসলামের প্রথম শহিদ হলেন আম্মার রা.-এর মা (সুমাইয়া), আবু জাহেল তাঁর লজ্জাস্থানে বর্শা দিয়ে আঘাত করে তাঁকে হত্যা করে।

‘মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা’ গ্রন্থে সাদ ইবনে উবাইদ আল কারি থেকে কাদেসিয়ার যুদ্ধের দিন সম্পর্কে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, আগামীকাল আমরা শত্রুর সামনাসামনি হব ইনশাআল্লাহ। আমরা শহিদ হতে চাই। (আমরা যদি শহিদ হই তা হলে) তোমরা আমাদের রক্তকে পরিষ্কার করো না। আমরা যে কাপড় পরিহিত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করব, তাতেই আমাদের দাফন করে দেবে।

হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি রাহিমাহুল্লাহ বলেন, সালফে সালিহিনগণ বদর ও উহুদ যুদ্ধসহ অন্যান্য যুদ্ধে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন, সকলকে শহিদ হিসেবে ব্যক্ত করেছেন। জ্ঞাতব্য হলো, ওই সমস্ত শহিদদের নাম এবং পরিচিতিসহ উল্লেখ করা হতো। উল্লেখ্য, মৃত্যুবরণকারী শহিদদের গোসল দেওয়া, কাফন পরানো এবং তাদের জানাজার নামাজ পড়ার বিশেষ বিধিবিধান রয়েছে, যা হাদিস এবং ফিকহের কিতাবসমূহে বর্ণিত হয়েছে...। আর এই বিশেষ বিধানের কারণেও মৃতব্যক্তিকে শহিদ হিসেবে ব্যক্ত করার প্রয়োজন দেখা দেয়।

উপরোক্ত দলিলসমূহ থেকে সুস্পষ্ট হয় যে, নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তিকে যথোপযুক্ত স্থানে শহিদ হিসেবে আখ্যায়িত করা বৈধ এবং রাসূলুল্লাহ সা. ও সাহাবায়ে কেরাম রা.-এর যুগ থেকে তার আমল চলে আসছে। আর বিপরীত মত পোষণকারীগণ যে সমস্ত দলিল পেশ করে থাকেন, তার দিকে দৃষ্টিপাত করলে বোঝা যায়, সে দলিলগুলো আসলে সতর্ক করছে যে, বাহ্যিকভাবে যা কিছু দেখা যায়, তা-ই সব নয়। ভেতরের অবস্থা অনেক সময় বাহ্যিক অবস্থার বিপরীতও হয়। সুতরাং অদৃশ্য বিষয়াদি যা একমাত্র আল্লাহ তায়ালার সাথে খাস, সেগুলোর বিষয়ে নিশ্চিত করে কোনো কিছু ব্যক্ত করা আমাদের জন্য উচিত নয়। আমরা শুধু বাহ্যিক অবস্থার ওপর হুকুম দিতে পারি, আর আল্লাহ তায়ালাই একমাত্র অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হুকুমের অধিকার রাখেন। সুতরাং অমুক শহিদ বা তাঁরা শহিদ এ কথা হুকুম দেওয়ার মানে হলো, তার প্রতি সুধারণা পোষণ করা এবং এটা বাহ্যিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে। সুতরাং তা জায়েয এবং এতে কোনো সমস্যা নেই। তবে কাউকে অকাট্যভাবে শহিদ প্রমাণ করার চেষ্টা করার সুযোগ নেই। এটা গাইবের অন্তর্ভুক্ত। এটা ঠিকও নয়; এর প্রয়োজনও নেই।

উল্লেখ্য, মানুষের বাহ্যিক অবস্থার প্রতি সুধারণা রাখা এবং অভ্যন্তরীণ অবস্থা আল্লাহ তায়ালার কাছে সোপর্দ করে দেওয়া সবচেয়ে নিরাপদ ও যথোপযুক্ত পন্থা। কারণ, রাসূল সা. বলেছেন, তোমরা যখন কোনো ব্যক্তিকে মসজিদে যাওয়ায় অভ্যস্ত দেখ, তাকে মুমিন বলে সাক্ষ্য দাও।

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে মুমিন হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। আর মসজিদে যাওয়ায় অভ্যস্ত হওয়া মুমিনের জন্য সাধারণত একটি বাহ্যিক অবস্থা। আবার কখনো কখনো মুনাফিকও মসজিদে যাওয়ায় অভ্যস্ত হতে পারে। ইহুদি, খ্রিষ্টান বা নাস্তিকদের এজেন্ট অথবা গুপ্তচররাও মসজিদে যাওয়ায় অভ্যস্ত হতে পারে...। এমনকি মসজিদুল হারামেও তাদের কেউ কেউ ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্যে নিয়ে প্রবেশ করতে পারে। কিন্তু এই সকল বিষয়াদি মসজিদে আগতদের মুমিন বলা বা তাদের ঈমানের সাক্ষী দেওয়ার ব্যাপারে বাধা হিসেবে ধর্তব্য নয়। তাই আমরা কাউকে মসজিদে প্রবেশে বাধা দিই না। শাহাদাত ও শহিদদের বিষয়টিও ঠিক এমনই।

হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি তাঁর গ্রন্থ ফতহুল বারি-তে ইমাম বুখারির উক্তি উল্লেখ করে বলেন, অমুক শহিদ এটা না বলার অধ্যায়ের মানে হচ্ছে, ওহির মাধ্যম ছাড়া কাউকে অকাট্যভাবে শহিদ সাব্যস্ত করা যাবে না। কিন্তু বাহ্যিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে শহিদের হুকুম দিতে সমস্যা নেই।

সহিহ বুখারির ব্যাখ্যা হাশিয়াতুস সিন্দিতে এসেছে, অমুক শহিদ এটা না বলার অধ্যায় অর্থাৎ আখিরাতের অবস্থা বিবেচনা করে কাউকে শহিদ আখ্যা দেওয়া যাবে না। তবে দুনিয়ার আহকামের বিবেচনায় শহিদ বলতে কোনো সমস্যা নেই।

লেখক পরিচিতি: ড . আহমাদ রাইসুনি বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় আলিমদের সংগঠন اتحادالعالمي لعلماء المسلمين এর সভাপতি।