কাজী জহিরুল ইসলামের আত্মগদ্য ‘আমার বিচিত্র জীবন’

কবি সে মানুষ যিনি এক অভূতপূর্ব শক্তির অধিকারী। সে শক্তি কিছু মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার দায় নিয়ে ভরা বাজারে `আমি কবি আমি কবি` হাঁক পেড়ে হাটে ঘাটে মাঠে খুইয়ে আসার জিনিস নয়।

মক্তব, মদ্রাসায় শিক্ষাপ্রাপ্ত যুবকের পক্ষে আর বোধহয় পশ্চিমবঙ্গে কবি হওয়া এবং স্বীকৃতি পাওয়া সম্ভব নয়। বাংলাদেশে কি সম্ভব? নজরুলের অভিব্যক্তি বুঝতে না পারলেও, বাঙালি যুবক-যুবতীরা, নর্তক-নর্তকীরা বলিউডের সালমান খান বা শাহরুখ খানের উর্দু সংলাপ দিব্বি বোঝেন ও নিজেদের বাক্যালাপে ব্যবহার করেন। 

প্রাগাধুনিক সমাজটি যখন আধুনিকতার ভান করেছে, তার ঘুর্ণিতে পড়তে হয়েছে নজরুলকে। মায়ের সঙ্গে মনোমালিন্যের দরুণ আচমকা সম্পর্ক ছিন্ন করে মেনে নিলেন রহস্যময় চিরবিচ্ছেদ। সিয়ারশোল স্কুল থেকে উৎখাত হলেন, কেননা প্রাগাধুনিক প্রকৃতিবাদী প্রধানশিক্ষক গিয়ে তাঁর জায়গায় এলেন আধুনিক সংস্কৃতিবাদী প্রধানশিক্ষক।

ত্রয়োদশ শতকে বর্তমান ইরাকের রাজধানী বাগদাদ শহর থেকে এসেছিলেন নজরুলের পূর্বপুরুষ মহম্মদ ইসলাম। ঘরসংসার মা-বাপ ফেছনে ফেলে অজানার উদ্দেশ্যে এই বেরিয়ে পড়ার আরবিক ইন্দ্রিয়চেনতা ও নারীসৌন্দর্যে স্তম্ভিত হওয়ার সংবেদন নজরুলকে কৈশোর থেকে আটপৌরে বাঙালিদের থেকে আলাদা করেছিল।

নজরুল সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েন স্কুলের বালক-বালিকাদের মঞ্চে। অথচ ভারতবর্ষে প্রতিবেশী পাকিস্তান বা চীনের সঙ্গে সামরিক সংঘর্ষ বাধলে বা শহরে দাঙ্গা লাগলে, এসট্যাবলিশমেন্ট ঝেড়ে-পুঁছে বের করে নজরুলের পদ্য ও গান।

নিরুত্তর থাকি। অনেক মৌনতার আড়ালে জলরাশির মতো শব্দগুচ্ছ আড়াল করে রাখি। কেন এই নিবেদন কেন এই একান্ত হতে চাওয়া তা বুঝেও নিজেকে প্রতিরোধ করি। কিন্তু সে প্রতিরোধ পলকা, বড় ওজনহীন মনে হয়। যে কোনো দ্বন্দ্বে আমি নিজেকে আক্রমণ করি সবথেকে বেশি।

মানবেতিহাস প্রকৃতপক্ষে লাগাতার সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের বহুমুখী ইতিহাস। তা সিংহাসনে রাজা-রানি বদলের গল্প নয়। ইতিহাসকে রাজা-রানি বদলের গল্পতে সীমিত রাখলে তা কেবল ক্ষমতাকেন্দ্রের ছত্রপতিদের কেচ্ছা নিয়ে মেতে থাকে। অবহেলিত থেকে যায় বিস্তীর্ণ ভূগোলের জনমানব।

প্রশ্ন হল, এই যে ক্ষমতা তা আসে কোথা থেকে? যে গোষ্ঠী শাসন করে, তারাই ক্ষমতার উৎসসূত্র। ক্ষমতা দখলের জন্য ভোটাভুটির নামে কতো খুনোখুনি হয় তা আমরা প্রতিটি নির্বাচনে দেখি । যারা ক্ষমতা দখল করে তারাই শাসক। শাসকের মূল্যবোধ চেপে বসে সমাজের সর্বত্র।