কাজী জহিরুল ইসলামের আত্মগদ্য ‘আমার বিচিত্র জীবন’

আমার ভেতরটা ভীষণ শব্দময়। কখনো ভীষণ নীরবতার মধ্যেও তার এক শব্দ থাকে, কয়েক টন জলের নিচে কান পাতলে যেমনটা শোনা যায়। তাই বাইরের শব্দাবলি সহজে আমার ভেতর অবধি আসে না। আসে ততটুকুই যতটুকু অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই।

গাছতলার মায়েদের কথা মনে পড়ে, সারাবছর বিভিন্ন অনুষঙ্গে যারা কৃষ্ণচূড়ার বেদীর কাছে জড়ো হতো, পরস্পরকে নাম ধরে ডাকাডাকি হাসাহাসি গসিপ করতো, আর ছুটির ঘণ্টা বাজলেই দূর থেকে যে যার মেয়েকে চিনে নিয়ে ছুটে যেত পরীক্ষা কেমন হলো জানতে। কত গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা সেসব জীবনের!

স্কুল লাইফে বন্ধুদের সাথে ঝগড়াঝাটির পর পুনরায় ভাব করার ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ কার হবে, এই নিয়ে হেব্বি চাপে থাকতাম। সত্যি বলতে, ফার্স্ট মুভটা নেয়া খুবই ডিফিকাল্ট ছিল। অপরপক্ষেরও একই সমস্যা হলে অনেক সময় তৃতীয় পক্ষের সাহায্য নিতাম। দুজনেই যখন দরজার দুই কোণে দাঁড়িয়ে, যেন কোনোদিনই ভাব করার ইচ্ছে নেই,

মেয়েদের চারটে চোখ থাকে, মাথার সামনে দুটো মাথার পেছনে আরো দুটো। আমার ধারণা ওটা চারটে নয়, ওটা ছটা। মেয়েরা সব দেখে, দেখতে পায়, যা তার চোখের সামনে ঘটে তা আবার যা তার চোখের পিছনে ঘটে, তাও। এই অদ্ভুত অতিপ্রাকৃতিক অতীন্দ্রিয় শক্তি ঈশ্বর ক’জন পুরুষমানুষের মধ্যে দিয়েছেন, আমার সন্দেহ আছে।

কিছু কিছু মানুষ আছে শুনেছি যাদের ওপর বহির্জগতের প্রভাব কম, তারা আপন অন্তর্জগতে এতটাই বুঁদ হয়ে থাকে যে, কোন পথে চলেছে তাদের খেয়ালই থাকে না। কারণ পথ কাটতে তিনি ব্যস্ত আপন অন্তরে। আমিও আত্মমগ্ন, তবু অতখানি আত্মকেন্দ্রিক নই সম্ভবত। ঘরের দেয়ালের রঙ হলুদ থেকে ঘননীল হলে আমি এক অন্য মানবী হয়ে উঠি

কোনো মহিলা যদি একটু উপযাচক হয়ে একজন পুরুষকে বলে, ‘আমি আপনাকে পছন্দ করি’, আরো এক ধাপ এগিয়ে, ‘আমি আপনাকে ভালোবাসি’ অথবা ফাইনালি, ‘আমি আপনার সাথে শুতে চাই’— তবে সেই আবেদনে সাড়া দিয়ে এগিয়ে যাওয়া কিংবা তাকে প্রত্যাখ্যান করা যেকোনোটাই করতে পারে সেই পুরুষ;

আম্মু-আব্বুর সেপারেশনের পর আমার আর কোথাও যাওয়া হইতো না। পার্মানেন্টলি নানাবাড়িতে রইয়া গেলাম। দোতালার মাঝখানের রুমে একটা পালঙ্ক আর একটা খাট ছিল। খাটে আমি, আম্মু, আর ছোটখালা শুইতাম। পালঙ্কে নানুমণি আর নানাভাই। পুরানা আমলের রাজবাড়ির আদলে এই বিল্ডিং। বিশাল বিশাল দুইটা ভেন্টিলেটরে স্টেইনগ্লাস।

তেমন করে আমার কোনো নেশা নেই। মদ সিগরেট গাঁজা কিংবা বিড়ি কোনোটাই নয়। পার্টিতে আড্ডায় কিংবা সেলিব্রেশনে, খুব ঘনিষ্ঠ দু একজন বন্ধুর অনুষঙ্গে, গাঢ় হতে দু এক পেগ চলে। ওইটুকুই। কোনো কিছুর অবলম্বনে কিংবা প্রশ্রয়ে অন্য অনেক কিছুকে ভুলে থাকার নির্ভরতা নেই আমার কোনো কিছুর ওপরেই।